বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ০২:৫৪ অপরাহ্ন

নকলায় বাঁশের তৈরি পণ্যে জীবন-জীবিকা

মো. মোশারফ হোসাইন:
  • প্রকাশের সময় | বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৩৮ বার পঠিত

শেরপুরের নকলা উপজেলার তিন শতাধিক পরিবারের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বাঁশের তৈরী পণ্য। উপজেলার চন্দ্রকোনা, নারায়ণখোলা, চরকৈয়া, মমিনাকান্দা, বারমাইসা, ছত্রকোনা, বাউসা, মোজার, চিথলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ৩ শতাধিক পরিবার এ পেশায় জড়িত।

এ পেশোতেই চলে তাদের জীবন জীবিকা। তাদের রুটি রুজির একমাত্র মাধ্যম বাঁশ। বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী তৈরি করে তা পাইকারী ও খুচরা হিসেবে বিক্রি করেই চলে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ পরিবারের সব খরচ।

উপজেলার চরঅষ্টধর ইউনিয়নের নারায়ণখোলা গ্রামের একটি এলাকার অধিকাংশ পরিবার এ পেশার সাথে যুক্ত থাকায় এলাকাটি বেপাড়িপাড়া হিসেবে পরিচিত। এখানের স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থী থেকে বৃদ্ধ সবাই এ পেশায় জড়িত।

নারীরা সাংসারিক কাজ শেষ করে এবং শিক্ষার্থীরা পড়ার লেখার ফাঁকে ও ছুটির দিন কাজ করেন। এ থেকে যে আয় হয় তাদিয়েই তাদের পড়া লেখাসহ সব খরচ চলে যায়। ফলে পরিবারের প্রধানকে তাদের ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচ বহন করতে বাড়তি চাপ নিতে হয়না।

নকলার বাঁশ শিল্পীরা বাঁশ দিয়ে সাধারণত ডালা, কুলা, চালনি, পানের ঢালা, মাছ ধরার ঝুড়ি, চাটাই, বিভিন্ন খেলনা, ধান মজুদের ডুলি, ধান রাখার গোলা, মাচা, বিভিন্ন ধরনের খাঁচাসহ মই ও গৃহসজ্জার বাহারি পণ্য ও দৈনন্দিন কাজের নানা রকমের জিনিস তৈরি করেন।

বিভিন্ন জেলাতে নকলার তৈরি বাঁশ পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। অনেক সময় অগ্রীম টাকা নিয়ে অর্ডার রেখেও তারা কাজ করেন। এতে করে বাঁশ কিনতে নিজের পকেটের টাকা ব্যয় করতে হয়না। ক্রেতাদের টাকাতে বাঁশ কিনে পণ্য তৈরি শেষে তাদের কাছে অল্প লাভে বিক্রি করা হয়। এসব বিক্রি করে চলে তাদের ছেলে মেয়ের লেখা পড়া ও সংসারের যাবতীয় খরচ।

অনেক সময় বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও ধার-দেনায় পুঁজি খাটিয়ে বাপ-দাদার এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন নকলা উপজেলার কয়েকশ’ বাঁশ শিল্পের কারিগর। তাদের তৈরি পণ্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহরে সরবরাহ করা হয়।

সরেজমিনে নকলা পৌরসভার চরকৈয়া গ্রামের বাঁশ পণ্যের নির্মাতা মোবারক আলী, ফসি আলী ও আশিক মিয়া এবং বারমাইশা গ্রামের নান্টু চন্দ্র বিশ্বাস, জগদীস চন্দ্র বিশ্বাসসহ অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলার পাইকাররা এখান থেকে বাঁশের তৈরি পণ্য কিনে নিয়ে নিজ এলাকায় বিক্রি করে সংসার চালান। এখানের শ্রমিকদের বাঁশের তৈরী পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাদের তৈরি পণ্য সমূহের মধ্যে মই, চালুন. খাচা, ধান রাখার ডুলি ও মাচা, চালুন ও কুলার চাহিদা সবচেয়ে বেশি।

বাঁশ শিল্পী মোবারক আলী জানান, স্থানীয় বিভিন্ন বাজারের দিন প্রায় ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য দিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকার বাঁশ পণ্য বিক্রি করতে পারেন। অনেক সময় খুচরা বিক্রেতারা তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে বাজারে বাজারে বিক্রি করেন। তাই তাদের কাছে খুচরা দামের চেয়ে কিছুটা কমে বিক্রি করা হয়। নির্মাতাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে তা বিক্রি করে যে লাভ পান। এমন খুচরা বিক্রেতাদের গড়ে দৈনিক লাভ থাকে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ টাকাতেই তাদের ছেলে মেয়ের শিক্ষা খরচসহ সংসারের সকল খরচ মেটাতে হয়।

নারী বাঁশ শিল্পী জোসনা জানান, তাদের ছেলে মেয়রাও তাদের ছুটির দিন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসে অবসর সময়ে সকাজে সহযোগিতা করে। তাতে বেশ কাজে লাগে। নতুবা বাড়তি সময় লাগতো। একা একা সব কাজ করলে একজন যতটা পণ্য তৈরি করতে পারেন, ছেলে মেয়রা কাজে সহযোগিতা করায় প্রতিজন বাঁশ শিল্পী বা বাঁশ শ্রমিক দেড়গুণ কাজ করতে পারেন।

মই তৈরির শিল্পী ফসি আলী নিজের মতো করে অঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘প্রতিডা চঙ্গ (মই) ছুডু গুনা ৪,০০ টেহা কইরা আর বড় গুনা এক হাজার-বারশ টেহা কইরা বেচুন যায়। একেকটা চঙ্গ বানাইতে ছুডু গুনা ৩,০০ টেহা আর বড় গুনা ৮শ’ থাইক্কা এক হাজার টেহা কইরা আঙ্গরে খরচ অয়। এতে যে নাভ অয় তা দিয়াই আঙ্গরে সংসার চালাইন নাগে। অহনত গিরস্তরা সব কিছু মেশিন দিয়াই কইরা হারে, তাই আগের মত মই, চালুন. খাচা, ডুলি, চালুন, কুলা এগুনা বেচাকেনা অয়না। আমরা আগের মত অহন নাভ পাইনা। এই কারনে আঙ্গরে পুলাপানরে বেশি নেহাপড়া করাবার পাইনা। আঙ্গরে পোলাপান কোন চাকরি বাকরি করবার পায়না। আঙ্গরে পোলাপানগরেও সারাজীবনই কষ্ট করুন নাগবো।’

অন্যএক বাঁশ শিল্পী কালাম অঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘আংগরে টেহা পয়সা কম, তাই বেশি কইরা বাঁশ কিনাবার পাইনা। ছোডু একটা থাহার ঘর ছাড়া আংগরে তেমুন কিছুই নাই। সরকার যদি ব্যাংক থাইক্কা আংগরে এই কামের নাইগ্যা ঋণ দেওনের ব্যবস্থা করত তাইলে আমরা অনেক কিছু করবার পাইতাম। পোলাপানরে বালা কইরা নেহা পড়া করাবার পাইতাম। তাতে খালি আংগরে নাভ অইত না, সরকারেরও নাভ অইত।’

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রোমান হাসান জানান, বাঁশ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামে কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মাঝে নিয়মিত অনুদান ও আর্থিক সহায়তা প্রদান কর্মসূচি চালু আছে।

এই বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, বাঁশ দ্বারা কৃষি পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করণের মাধ্যমে উপজেলার অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে সহজপ্রাপ্য প্লাস্টিক পণ্য সহজলভ্য হওয়ায় বাঁশ শিল্প আজ হুমকির মুখে। বাঁশ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং ঘর বাড়ীকে প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করতে বাড়ীর আঙ্গীনার পতিত জমিতে বাঁশ রোপন করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।

বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িতরা জানান, ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে ঐতিহ্যবাহী ও পরিবেশ বান্ধব বাঁশ শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। দিন দিন কমছে বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িতদের সংখ্যা। এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, তাছাড়া প্রশিক্ষণ এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা। এসব করতে পারলে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে।

সরকার বাঁশ শিল্পীদের সহজ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে নিয়মিত কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করে ব্যাংকিং খাতেও সুনাম অর্জন করতে পারতেন। তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করা গেলে এই ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্পের কাজের গতি বেড়ে যাবে এবং শ্রমের অপচয় কম হবে। ফলে তারাও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশীদার হতে পারবেন বলে মনে করছেন স্থানীয় সুধীজনরা।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ

এই জাতীয় আরো সংবাদ
©২০২০ সর্বস্তত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত | সমকালীন বাংলা
Develop By : BDiTZone.com
themesba-lates1749691102
error: ভাই, খবর কপি না করে, নিজে লিখতে অভ্যাস করুন।