কালের বিবর্তনে এক সময়ের রাজকীয় বাহন ঘোড়ার গাড়ি রূপ বদলালেও এখনো প্রয়োজন ফুরায়নি। বর্ষা কালে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের চরাঞ্চলের পথ-ঘাট থাকে কর্দমাক্ত এবং শুকনো মৌসুমে শুধুই ধূ ধূ বালুচর। ব্রহ্মপুত্রের বালুচরের বুকে টগবগিয়ে এখনো ছুটে চলে ঘোড়ার গাড়ি। চরাঞ্চলের একমাত্র বাহনও বলা হয় ঘোড়ার গাড়িকে।
সভ্যতার যুগ ও কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার মানুষের একমাত্র যোগাযোগের বাহন গরুর গাড়ির ব্যবহার হারিয়ে গেছে। তবে চরাঞ্চলে এখন যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের প্রধান বাহন হিসেবে দাঁড়িয়েছে ঘোড়ার গাড়ি। বর্ষার সময় যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা আর কর্দমাক্ত রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি। চরবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ও হাটবাজারে পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করেন।
রেহার চরের ঘোড়ার গাড়ির চালক কালাম মিয়া বলেন, বর্ষাকালে নৌকা আর শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি চালাই। এতে দৈনিক ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা আয় হয়। এই আয় দিয়েই ঘোড়ার খাবারসহ ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ ও সংসারের যাবতীয় ব্যয় চলে।
চরবাছুর আলগীর আইয়ুব আলী বলেন, ‘শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় জেগে উঠে ছোট বড় চর। এখানে বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি যেন মানুষের একমাত্র ভরসা। এ ছাড়া চরের কৃষকদের উৎপাদিত ফসল জমি থেকে তুলে বাড়িতে ও পরবর্তীতে হাট-বাজারে বিক্রি করার জন্য নদীর ঘাটে আনার মাধ্যম এই ঘোড়ার গাড়ি।’
চরখারচর গ্রামের ঘোড়ার গাড়রি মালিক কব্দুল মিয়া জানান, চরাঞ্চলের কর্দমাক্ত পথে এবং উঁচু নিচু ও বালুমিশ্রত রাস্তায় ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল পরিবহন করা গেলেও, চরাঞ্চলের কেউ অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চরম বিপাকে পড়তে হয়। অসুস্থ রোগীকে ঘোড়ার গাড়িতে হাসপাতালে নিতে হলে আকাবাঁকা, উঁচু নিচু ও অর্ধভগ্ন রাস্তা দিয়ে চলার সময় অতিরিক্ত ঝাঁকুনিতে রোগী আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ডৌহা তলা গ্রামের রহিম উদ্দিন জানান, কয়েক বছর আগেও এই চরে ৫০-৬০টি ঘোড়ার গাড়ি চলতো। কিন্তু এখন তা বেড়ে শতাধিক হয়েছে। চরাঞ্চলের কৃষকের উৎপাদিত ধানসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য হাট-বাজারে আনা-নেওয়া ছাড়াও পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে বেশ কষ্ট পোহাতে হয়। তাই পেশাদার ঘোড়ার গাড়ির চালক ছাড়াও চর অঞ্চলের কৃষকরাও নিজস্ব ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার শুরু করেছেন। এছাড়া সৌখিন পরিবহন হিসেবে এই ঘোড়ার গাড়ির কদর দিন দিন বাড়ছে বলে তিনি জানান।
মানিকার চরের ফজল আলী জানান, চরবাসীর কষ্টে উৎপাদিত স্বপ্নের ফসল ধান, গম, ভ‚ট্টা, বেগুন, টমেটো, মরিচ, গোলআলু, মিষ্টি আলু, পেয়াজ, রসুন, আদা ও বাদামসহ বিভিন্ন ফসল চরাঞ্চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে খুবই কষ্ট হয়ে থাকে। তাই এ কষ্ট লাঘবে শত বছর পূর্ব থেকেই ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করছেন চর অঞ্চলের কৃষকেরা।
তরুণ সাংবাদিক শীমানুর রহমান সুখন বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়িতে বিভিন্ন স্থানে যেতাম। আগে প্রায় সড়কেই চলত ঘোড়ার গাড়ি চলত। সেসময় গ্রামাঞ্চলে ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল ও বিয়ের অনুষ্ঠানে যাতায়াতে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সিএনজি আটোরিকশা ও ইঞ্জিন চালিত গাড়ির কারণে এখন আর আগের মতো সব সড়কে ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখা মেলে না। এখন ঘোড়ার গাড়ি দেখতে শহরের মানুষ চর অঞ্চলে ঘুরতে আসেন। কেউ কেউ শখ করে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে ঘুরাঘুরি করে আনন্দ উপভোগ করেন।’
পাঠাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘বিভিন্ন ঐতিহাসিক দিনে ঘোড়া, গরু ও মহিষের গাড়ির উপস্থিতি বর্তমান প্রজন্মের ছোট ছেলে মেয়েদের নজর কাড়ে। কোন কোন ছেলে মেয়ের আবদার রক্ষায় অভিভাকগন তাদের সন্তানদের ঘোড়া, গরু ও মহিষের গাড়িতে উঠাতে বাধ্য হন।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুধু ঐতিহ্য রক্ষার জন্য নহে, পরিবেশ রক্ষাসহ দূর্ঘটনার হাত থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে গরু, ঘোড়া ও মহিষের গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি।’ তাতে একদিকে যেমন যাত্রা ও পরিবহণ নিরাপদ হবে, অন্যদিকে টাকাও বেচে যাবে। জ্বালানি বিহীন যানবাহনের ব্যবহার বাড়াতে পাড়লে টাকা অপচয় রোধসহ সৃষ্টি হবে নিরাপদ বসবাস উপযোগি পরিবেশ। কমবে দূর্ঘটনা, বাড়বে মানব সম্পদের পরিমাণ; এমটাই মন্তব্য করেন তিনি।
সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি, তাই অন্তত গ্রামের রাস্তা গুলোতে যন্ত্রতন্ত্র ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, অটোরিক্সা, সিএনজি চালিত ছোট গাড়ি তথা ক্ষতিকর যানবাহন বন্ধ করে গরু, ঘোড়া ও মহিষের গাড়ি এবং পায়ে চালিত রিক্সা ও বাইসাইকেল ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষ করে দুর্ঘটনা এড়াতে তথা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনেই ঘোড়ার গাড়ি টিকিয়ে রাখা দরকার বলে মনে করছেন সচেতন মহল।