মাটির স্পর্শ ছাড়াই কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাগ ট্রেতে বা প্লস্টিকের ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহার করে শাক-সবজি ও ফল-ফুলসহ বিভিন্ন ফসলের চারা উৎপাদনে কৃষকরা অনেক সুবিধা ভোগ করছেন। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী কৃষি উদ্যোক্তা শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক।
সে এস.এস.সি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত সকল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেও সরকারি-বেসরকারি কোন চাকরির জন্য একটি আবেদনও করেননি তিনি। সৌমিক প্রমান করেছেন উচ্চ শিক্ষিত হলেই চাকরির পিছনে দৌঁড়াতে, হবে তা ঠিক না।
উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইচ্ছা শক্তি, মেধা ও দৃঢ় সংকল্প থাকলে যেকোন ক্ষেত্রে পরিশ্রম করে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তাতে সফল উদ্যোক্তার সুপরিচিত পাওয়া যায়। এমনটাই প্রমান করেছেন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক।
তার ইচ্ছা, সে নিজে চাকরি করবেন না, বরং অন্যকে চাকরি দিবেন। এই ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়েই ৪ বছর আগে তার পথ চলা শুরু। এরপর তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সফলতা তাকে পৌঁছে দিচ্ছে উচ্চতম স্থানে। এরইমধ্যে উচ্চ শিক্ষিত সৌমিক হয়ে উঠেছেন শিক্ষিত তরুণদের অনুকরণীয় ব্যক্তি রূপে।
সে চাকরির আবেদন না করলেও কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার নেশায় ও চাকরি দাতা হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কৃষি বিভাগ ও প্রাণি সম্পদ বিভাগসহ বিসিক, যুব উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো বেশ কয়েকটি দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহন করেছেন। এসব প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই আজ সে সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিতি পেয়েছেন। হয়েছেন আত্মনির্ভশীল, পরিণত হয়েছেন চাকরি দাতা হিসেবে।
তার মৌমাছির খামারে, ফুল-ফল ও চারা উৎপাদনের নার্সারিতে, গরু ও মুরগীর খামারে এবং ফলজ ও কাঠের বাগানে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় কর্মসংস্থানের সন্ধান পেয়েছেন অনেকে। নতুন করে আধুনিক প্রযুক্তিতে মাটির ব্যবহার ছাড়াই কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ট্রের (প্লাগট্রে) মধ্যে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহার করে শাক-সবজি ও ফল-ফুলসহ বিভিন্ন ফসলের চারা উৎপাদন শুরু করে সবার নজর কেড়েছেন। আর সৌমিকের এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের সুবিধা ভোগ করছেন বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় সব ধরনের কৃষক। বিশেষ করে ছাদ বাগানে তার উৎপাদিত চারা বেশি ব্যবহার করা হয়। সৌমিকের কাছে ১৫-২০ দিন বয়সী ও চাহিদা মোতাবেক চারা স্বল্প মূল্যে পেয়ে সবাই খুশি। এতে কৃষকদের আলাদা ভাবে চারা উৎপাদন করতে হচ্ছেনা। ফলে জমি নির্বাচন, বীজতলা তৈরি, বীজ ও সার, সেচ, পরিচর্যা ও আলাদা সময় ব্যয় করতে হচ্ছেনা কৃষকদের। বরং স্বল্প মূল্যে ১৫-২০ দিন বয়সী নিরোগ চারা পাচ্ছেন তারা। তাই এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারার চাহিদা ও কৃষকের আগ্রহ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে সৌমিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সে প্লাগ ট্রেতে নারিকেলের ছোবড়া (কোকোডাস্ট) ও শুকনা জৈবসারের মিশ্রনের মধ্যে বিভিন্ন জাতের বীজ বপন করছেন। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে তার সারা বছর আয় হয় বলে তিনি জানান। প্লাগ ট্রেতে মাটি ব্যবহার করলে তা ভারি হয়ে যায় এবং সেচের দরকার হয়। তাই পানি ধারণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা সম্পন্ন কোকোপিট ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তিটি এক ধরনের হাইড্রোপনিকস প্রযুক্তি হিসেবেও পরিচিত।
শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক জানান, এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় রোগবালাইয়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত এসব চারা কৃষকদের মাঝে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করেন তিনি। তিনি জানান, ক্যাপসিক্যাম, স্ট্রবেরি, হাইব্রিড জাতের মরিচ, বেগুন, লাউ, কুমড়া, তরমুজ, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নত জাতের ফল ও ফুলের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে মোটা অংকের টাকা লাভ থাকে তার। ট্রেতে বীজ বপন শেষে বিশেষ কৌশলে নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ফলে কোনো ধরনের কীটপতঙ্গ চারাগাছকে আক্রমণ করতে পারে না। ফলে চারাগুলো সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে উঠে।
উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে বিভিন্ন সবজির উৎকৃষ্ট গুণমানের ও অসময়ে সবজি চাষের প্রচলন বেড়েছে। বিভিন্ন রোগ ও কীটশত্রু সহনশীল, উচ্চফলনশীল উচ্চ দামের সবজির চারা তৈরির জন্য বর্তমানে প্লাগ ট্রে বা পোর ট্রে বহুল ব্যবহার হচ্ছে। এই প্রযুক্তির প্রধান উপাদান হল চারা তৈরির প্লাস্টিকের ট্রে। এতে ছোট টবের আকৃতির খোপ থাকে। খোপে মাটি না দিয়ে বিশেষ গ্রোথ মিডিয়াম (কোকোপিট) দিয়ে ভরা হয়। পরে প্রতি খোপে একটি করে বীজ রোপন করে চারা তৈরি করা হয়। এই খোপগুলিকে প্লাগ বা পোর বলে। প্রতিটি প্লাগের তলায় টবের মতোই পানি নির্গমনের জন্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে। স্বল্পকালীন সবজি ফসলের জন্য সাধারণভাবে যেসব ট্রে ব্যবহার করা হয় তাতে ৯৮টি বা ১০২টি বা ১০৪টি করে খোপ বা প্লাগ থাকে। তবে বর্তমানে সবরকম চারা উৎপাদনের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় আকারের খোপ বিশিষ্ট প্লাগ ট্রে বাজারে পাওয়া যায়।
নকলা প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলে রাব্বী রাজন ও নূর হোসেন জানান, গত বছর সৌমিকের কাছ থেকে কোকোডাস্ট পদ্ধতিতে উৎপাদিত বেশ কিছু সবজির চারা নিয়ে টপে রোপন করে ছিলেন। তাতে অল্প সময়ে ভালো ফলন পেয়েছেন তারা। তাই এবারও সৌমিকের কাছ থেকে ১৫-২০ দিনের সুস্থ, সবল ও বালাইমুক্ত সবজির চারা কিনতে উপজেলা মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত বিজয় মেলাতে এসেছেন। তরুণ সাংবাদিক হাসান মিয়া ও লিমন আহমেদ জানান, তারা অন্যের কাছে শুনেছেন মেলাতে মাটির স্পর্শহীন কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাগ ট্রেতে উৎপাদিত ১৫-২০ দিনের চারা পাওয়া যায়। তার এবছর প্রথম বারেরমত নতুন এই প্রযুক্তির চারা রোপন করবেন। চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বন্দটেকী এলাকার শিক্ষার্থী শীমানুর রহমান সুখন জানান, তিনি সৌমিকের কাছথেকে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন শাক-সবজির চারা এনে লাগান। চলতি মাসে তার খাছথেকে উন্নত জাতের ২০টি ড্রাগ গাছের কাটিং করা চারা এনে লাগিয়েছেন। আগামীতে তারা সবাই কোকোডাস্ট পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা রোপন করবেন এবং অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করবেন বলেও তারা জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিম মেহেদী বলেন, মাটির স্পর্শ ছাড়াই কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাগ ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহারে পরিকল্পিত ভাবে সহজেই নিরোগ চারা উৎপাদন সহজ। কোকোডাস্টের পানি ধারণক্ষমতা বেশি। তাই খুব সহজেই সতেজ যেকোনো বীজ থেকে চারা গজায়; যা সুস্থ, সবল ও বালাইমুক্ত। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন মাঠ পর্যায়ে বিস্তার ঘটাতে পারলে সবাই আগ্রহী হবেন। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে; কমবে বেকারত্ব, সমৃদ্ধ হবে দেশের কৃষি অর্থনীতি। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে শিক্ষিত তরুণসহ যেকেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।
ক্যাপশন: কোকোপিট পদ্ধতিতে প্লাগ ট্রেতে কোকোডাস্ট ও জৈবসার ব্যবহারে প্লাস্টিকের ট্রেতে উৎপাদিত চারা হাতে শেরপুরের নকলা উপজেলার ৯নং চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামের অর্থনীতি বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করা কৃষি উদ্যোক্তা শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক।