শেরপুরের নকলা উপজেলার নদ-নদীর চরাঞ্চলনে ও ছোট-বড় বিলপাড়ের যে দিকে দৃষ্টি যায় দিগন্তজুড়ে শুধু সরিষার মাঠ নজরে পড়ে। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৫,৭৮০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছ। গত বছরের চেয়ে ৪৮০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ বেড়েছে। এবার সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভালো ফলনের আশায় কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবছর উপজেলায় সরিষার আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে। আর গত বছর এর আবাদ হয়েছিলো ৫,৩০০ হেক্টরে এবং ২০২২ সালে সরিষার আবাদ হয়েছিলো ২,৭০০ হেক্টর জমিতে। এ হিসেব মতে দুই বছরের ব্যবধানে উপজেলায় সরিষার আবাদ দ্বিগুণের চেয়ওে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হারে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির কারন হিসেবে জানা গেছে, কৃষকদের মাঝে সরকারি প্রণোদনা প্রদান, পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বীজ-সার বিতরণ ও অধিক লাভের আশায় কৃষকদের দিন দিন আগ্রহ বৃদ্ধি।
ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্ব ছাইদুল হকসহ অনেকে জানান, সরিষা একটি মধ্যবর্তী ফসল, তাছাড়া সরিষাতে উৎপাদন খরচ কম, কিন্তু লাভ বেশি পাওয়া যায়। তাই আগাম আমন ধান কাটার পরে তাদের সব জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। কৃষকরা জানান, সরিষা উঠিয়ে ওই ক্ষেতে বোরো আবাদ করা হবে। এই বোরো আবাদে বাড়তি চাষ, সার ও পরিশ্রম কম লাগে; কিন্তু ফলন ভালো হয়।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশরাফুল আলম, হুমায়ুন কবির ও আনোয়ার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, নকলা উপজেলার প্রায় সব এলাকার কৃষকরা গত কয়েক বছর ধরে সরিষা আবাদ করে বাড়তি আয়ের পথ খোঁজে পেয়েছেন। তাই দিন দিন উপজেলার সব এলাকার কৃষকরা সরিষার দিকে ঝুঁকছেন।
বানেশ্বরদী ইউনিয়নের কায়দা গ্রামের বিধবা কৃষাণি মোছা. রাশিদা বেগম শান্তি জানান, তিনি ৩০ শতাংশ জমিতে মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে সরিষা আবাদ করেছেন। সরিষা তোলার পরে ওই জমিতে বোরো ধান রোপন করবেন তিনি। এতে যা খরচ হয়েছে এবং যা খরচ হবে, তার দ্বিগুণ লাভ পাবেন বলে তিনি আশাব্যক্ত করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাগর চন্দ্র দে ও ফারিহা ইয়াসমিন জানান, উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়ন, চরঅষ্টধর, টালকী, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী, গৌড়দ্বার, নকলা ও উরফা ইউনিয়নসহ পৌরসভায় সরিষার আবাদ করা হয়েছে। তবে চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী ও উরফা ইউনিয়নে আবাদ বেশি হয়েছে। তিনি আরো জানান, সরিষা চাষের উপযোগী সব জমিকে আবাদের আওতায় এনে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা ও কৃষিপণ্য উৎপাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের পরামর্শ সেবা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার কৃষককে দেওয়া হয়েছে প্রণোদনা ও ৬ হাজার ৩০০ জনকে দেওয়া হয়েছে পুনর্বাসন সহায়তা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, এবছর নকলা উপজেলায় স্থানীয় জাতের পাশাপাশি বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৭, বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১১ ও স্থানীয় টরী-৭ জাতের সরিষা আবাদ করা হলেও সবচেয়ে বেশি আবাদ করা হয়েছে যথাক্রমে বারি সরিষা-১৪, টরী-৭ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা। তিনি আরো জানান, সরিষা চাষের উপযোগী সব জমিকে সরিষা আবাদের আওতায় এনে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগের সম্মূখিন না হলে, এ বছর সরিষার উৎপাদন বাড়বে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী বলেন, এবছর নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে বিনাচাষে ৪৩০ একর জমিতে সরিষার বাড়তি আবাদ করা হয়েছে। এমন আবাদ চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরবাছুরআলগী এলাকায় বেশি হয়েছে বলে তিনি জানান। নতুন প্রযুক্তিতে আমন ধান কাটার ৭ থেকে ১০ দিনে আগে ধান ক্ষেতে প্রতি বিঘাতে এক কেজি করে সরিষা বীজ বপন করা হয়। ধান কাটার পরে সরিষাতে সামান্য সার ও প্রয়োজনীয় হালকা সেচ দিলে ভালো ফলন পওয়া যায়। এতে একদিকে জমি চাষ ও বীজ বপনের আগে জমিতে সার বাবদ খরচ লাগেনা; অন্যদিকে জমিতে সঠিক সময়েই বোরো ধান রোপন করা যায়। আগামী থেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে সরিষার আবাদ বাড়বে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।