উচ্চ শিক্ষিত হলেই চাকরির পিছনে দৌঁড়াতে হবে তা ঠিক না। উপযুক্ত প্রশিক্ষন, ইচ্ছা শক্তি, পরিশ্রম, মেধা, দৃঢ় সংকল্প এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় মৌমাছি লালন-পালন করেও স্ববলম্বী হওয়া সম্ভব। হওয়া যায় সুপরিচিত ও সফল উদ্যোক্তা। এমনটাই প্রমান করেছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন কারী সফল কৃষি উদ্যোক্তা শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিক।
সে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেও সরকারি-বেসরকারি কোন চাকরির জন্য একটি আবেদনও করেননি। তার ইচ্ছা, সে নিজে চাকরি করবেন না, বরং অন্যকে চাকরি দিবেন। এই ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়েই তার পথ চলা শুরু। এরপর তাকে আর পিছনে তাকতে হয়নি। একের পর এক সফলতা তাকে পৌঁছে দিচ্ছে উচ্চতম স্থানে। এরইমধ্যে উচ্চ শিক্ষিত সৌমিক হয়ে উঠেছেন শিক্ষিত তরুণদের অনুকরণীয় ব্যক্তি রূপে। মৌমাছি লালন-পালন করে বা মৌ চাষ করে সৌমিকের মত অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তারা হয়েছে আত্মনির্ভরশীল, পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। তাদের দেখা দেখি অনেকেই মৌ চাষে আগ্রহী হয়েছেন। চাকরির জন্য তাদের মানসিক চাপ কমেছে।
সৌমিকের মৌমাছির খামারে কাজ করেন বেশ কয়েকজন দক্ষ শ্রমিক। এছাড়া তার ফুল-ফল ও চারা উৎপাদনের নার্সারিতে, গরু ও মুরগীর খামারে এবং ফলজ ও কাঠের বাগানে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সন্ধান পেয়েছেন অনেকে। সৌমিকের আওতায় তার কৃষি বিষয়ক প্রকল্প সমূহে অন্তত ১০-১৫ জনের নিয়মিত কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মৌসিমু কাজের সন্ধান পেয়েছেন ৪০-৫০ জন কৃষি শ্রমিক।
যুগানিয়া এলাকায় স্থাপন করা সৌমিকের মৌমাছির খামারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সে নতুন বানানো মৌ বক্সে রং করছেন ও সংস্কার করছেন সামান্য ভেঙ্গে যাওয়া পুরাতন মৌ বক্স। কাজের ফাঁকে তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, সে যখন বুঝতে শিখেছেন, তখন থেকেই কারো নিয়ন্ত্রনে চাকরি করা পছন্দ করেন না। সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রায়ই নিজের কোন মতামতের গুরুত্ব পাওয়া যায় না। তাই চাকরি করাকে তিনি সর্বজন স্বীকৃত দাসত্ব বলে মনে করেন। এমন চিন্তা ভাবনা মাথায় রেখে সে ছোটকাল হতেই চাকরিকে মনে মনে দূরে ঠেলে রাখেন। তার ধারনা, যেখানে নিজের মতামতের কোন গুরুত্ব পাওয়া যায়না, সেখানে না যাওয়াই উত্তম। তাই সে লেখাপড়া (অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স) শেষ করেও কোন চাকরির জন্য আবেদন কেরননি।
সৌমিক চাকরির আবেদন না করলেও কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার নেশায় ও চাকরি দাতা হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কৃষি বিভাগ ও প্রাণি সম্পদ বিভাগসহ বিসিক, যুব উন্নয় ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো থেকে বেশ কয়েকটি দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহন করেছেন। এসব প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই আজ সে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিতি পেয়েছেন। হয়েছেন আত্মনির্ভশীল, পরিণত হয়েছেন চাকরি দাতা হিসেবে।
নকলায় যথেষ্ট বনায়ন না থাকায় বছরের কয়েক মাস মৌ বক্সগুলো মধুপুর গড়ের নিকটে এবং গারো পাহাড়ে রাখা হয়। শুধুু মাত্র সরিষা ও আম, লেচুসহ মৌসুমি ফলের মৌসুমে এলাকাতে আনা হয়। জানা যায় প্রতি বক্সহতে বছরে গড়ে ২৫-৩০ কেজি মধু পাওয়া যায়। মৌসুম ভেদে সরিষার মধু ১২ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা, লিচুর মধু ১৪ হাজার টাকা থেকে ১৭ হাজার টাকা, কালোজিরার মধুু ১৭ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা প্রতিমন হিসাবে বিক্রি করা যায়। তবে মধুর চাহিদা ও উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে অনেক সময় দাম উঠা-নামা করে বা কম-বেশি হতে পারে। সারা বছর পাহাড়ী ও কালোজিরার মধুুর দাম বেশি থাকে।
স্থানীয় ভাবে তাদের উৎপাদিত সব মধু বিক্রি করা সম্ভব হয়না। তাই বাংলাদেশ মৌ চাষী সমিতির নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ভারতসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। মধু রপ্তানির বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের বন্ধুদেশের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পারলে এবং সার্বিক সহোযোগিতা ও সহজ ব্যাংক ঋণ দানে ব্যবস্তা করলে মৌ চাষে তারা নজির ঘটাতে সক্ষম বলে মৌ চাষীরা মনে করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিম মেহেদী বলেন, নকলার আবহাওয়া সরিষা চাষের জন্য উপযোগী। এখানে সরিষা আবাদ বেশি হয়। তাই শীত কালে নকলায় চরাঞ্চলসহ উপজেলার প্রায় সব এলাকাতেই সরিষার আবাদ হয় এবং এখানকার পরিবেশ মৌ চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তাই এখানে মৌ খামারিরা তাদের খামার স্থানান্তর করেন। তিনি আরো বলেন, মৌমাছিরা সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করায় সহজে পরাগায়ণ ঘটে, ফলে সরিষার ফলন অনেক বেশি হয়। তাই মৌ চাষি এবং মধু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণসহ সবধরনের সহযোগিতা করা হয় বলেও তিনি জানান।
বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের উৎপাদিত খাঁটি মধুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকারি বিনিয়োগ, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধুতে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বহিঃবিশ্বে রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। মৌ-চাষের উন্নতির জন্য সরকারকে ধান, পাট ও ইক্ষু গবেষণার ন্যায় মধু গবেষনা কেন্দ্র বা ইন্সটিটিউট স্থাপন করলে কৃষকরা তথা মৌ-চাষিরা অর্থিক ভাবে লাভবান হবেন বলে মনে করছেন মৌ খামারি শাউদা মোসলেউর রহমান সৌমিকসহ অনেকেই। এতে করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কমবে বেকারত্ব, সমৃদ্ধ হবে দেশের কৃষি অর্থনীতি; এমনটাই মনে করছেন সুশীলজন।