চলমান কোটা সংস্কার ও মেধাভিত্তিক নিয়োগে সরকারি পরিপত্র বহাল রাখার দাবিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনরতদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে মানববন্ধন করেছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার সর্বস্তরের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বুধবার (১৭ জুলাই) সকাল ১০ টার দিকে বঙ্গবন্ধু চত্ত¡রের সামনে ৪০ মিনিট ব্যাপি শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করা হয়।
মানববন্ধনে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হয়। তাছাড়া কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, একটা যৌত্তিক দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাদের দাবি না মেনে উল্টো তাদের ওপর বর্বর হামলা করা হচ্ছে। তারা জানান, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিকভাবে হামলা করছেন। শিক্ষার্থীদের ওপর যদি হামলা বন্ধ করা না হয় তাহলে আগামীতে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কর্মর্সূচি গ্রহণ করা হবে।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেওয়া বিভিন্ন শ্লোগানে বঙ্গবন্ধু চত্ত¡র এলাকা মুখরিত হয়েওঠে। তাদের দেওয়া শ্লোগান গুলোর মধ্যে “মেধার হোক জয়, কোটার হোক পরাজয়”, “কোটাকে নয় মেধাকে মূল্যায়ন করুন”, “যদি কোটা রাখতেই হয়, ১০% এর বেশি নয়”, “নাতিপুতির কোটা মানি না, মানব না”, নাতিপুতির কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন চাই”, “কোটার নামে কুঠার দিয়ে মেধাবীদের গায়ে আঘাত কেন?” এসব ছিলো উল্লেখযোগ্য।
মানববন্ধন শেষে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশের মৌখিক বাধায় তারা বঙ্গবন্ধু চত্ত¡রের সামনে থেকে সড়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিবিদ্যা নিকেতনের সামনে সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এ সময় বক্তরা সারা দেশে চলমান কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন।
মানববন্ধনে অংশ গ্রহনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে বলেন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা জাতীয়তার পরিচয়ে বাংলাদেশী লেখতে পারি, তাদেরকে সর্বোচ্চ সম্মান করা উচিত এবং সম্মান করি। সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে চাকরির কোটা বিবেচনায় তাদেরকে চাকরি দেওয়ায় আমরা কেউ কোন প্রকার আপত্তি করিনাই; আপত্তি করার মতো কোন যুক্তিও নেই। তাইবলে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধাবী মূল্যায়ন নাকরে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিদের মুক্তিযোদ্ধা দাদা-নানার পরিচয়ে কোটার বিবেচনায় চাকরি দিলে তা অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন তারা। তারা বলেন, এমন অযৌক্তিক কোটারীতি মেনে নেওয়ার মতো নয়, কেউই মেনে নিবেন না। তাই সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের জোর দাবীর পাশাপাশি শিক্ষার্থীর ওপর বর্বর হামলাকারীদের চিহৃত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবী উত্থাপন করেন তারা।
বক্তারা কোটা সংস্কারের ইতিহাস টানতে গিয়ে জানান, শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোটা বাতিলের পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় দেন মহামন্য হাইকোর্ট। এতে সারা দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ সরকারি কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তার উদ্রেক ঘটে।
আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার এবং নারীদের জন্য যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ১০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে শহীদ হওয়াতে তাদের পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারায়। পাক হানাদার বাহিনী অনেকের বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলে। অনেকে পরিবার তাদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে হারান। অনেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তখন বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা করা সময়োপযোগী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। তাছাড়াও তৎকালীন নারী শিক্ষায় এই জনপদ অনগ্রসর ছিল। তখন নারীরা অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পড়ালেখা করেছেন। সে জন্য তাদের জন্যও কোটা থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু ওইসব প্রতিক‚লতা আর নেই।
তারা বলেন, বর্তমান সময়ে এসে প্রায় সকল মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। তাদের পরিবারের ছেলে মেয়েরা অস্বচ্ছল জীবন যাপন করলেও, তাদের নাতী-নাতনিদের আগের অনগ্রসর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা বাধ্যতামূলক বা অতিব জরুরি বলে তারা মন্তব্য করেন।
তারা জানান, বর্তমানে দেশের সাক্ষরতার হার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। যেখানে নারীদের সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশেরও বেশি। দেশে নারীরা শিক্ষা ও যোগ্যতায় অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। নারীরা তাদের আত্মমর্যাদা ও অধিকারের প্রতি যথেষ্ট সচেতন। ১০ শতাংশ নারী কোটা বজায় রাখাটাও আত্মমর্যাদাশীল নারীদের প্রতি অসম্মানজনক। তাই আমাদের মাঝে উপস্থিত নারীরাও এই বিশেষ কোটা সুবিধা চাচ্ছেন না। তারাও তাদের জন্য বরাদ্দকৃত নারী কোটাসহ সকল কোটা সংস্কার কামনা করছেন।
জেলাকোটা বর্তমানে যৌক্তিক বলে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, আগে দেশের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বেশকিছু প্রত্যন্ত জেলা অনগ্রসর ছিল। এ জন্য ১০ শতংশ জেলা কোটা রাখা হয়েছিল। বর্তমানে বঙ্গবন্ধর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ পরিচালনায় পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, অগণিত ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। ফলে সারাদেশ এখন একসঙ্গে যুক্ত। তাছাড়াও টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এবিবেচনায় প্রত্যন্ত জেলা বলতে এখন আর কোন জেলা নেই। তাই এখানেও ১০ শতাংশ কোটা রাখা-নারাখার বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, একটি বিশেষ কোটাকে যাতে কোনও ব্যক্তি বংশানুক্রমে তার জীবনের ধাপে ধাপে সুবিধা ভোগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারেন, সে জন্য প্রশাসনের সঠিক অবকাঠামো গঠন করার আবশ্যক বলে তারা মন্তব্য করেন।
তারা বলেন, আমার এখন আর অনুন্নত দেশের নাগরিক নই। বর্তমানে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশের মেধাবীরা প্রতিনিয়ত জাতীয় ও আনস্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজেদের সামর্থ ও সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে আসছে। আগামীর বাংলাদেশের কন্ডারি হবে বর্তমানের মেধাবীরাই। তাই মেধার সর্বাত্মক সুযোগ বজায় রাখা সকলের কাম্য।
এসব বিবেচননায় তথা দেশ ও জাতির মঙ্গলে দেশের সবস্তরে কোটা সংস্কার বিষয়ক যেসব আন্দোলন হচ্ছে তা যৌক্তিক দাবী মন্তব্য করে দ্রæত কোটা সংস্কারের দাবী করেন তারা। আদালতের প্রতি মেধার মূল্যায়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে যুগান্তকারী একটি রায় দিতে অনুরোধ জানান আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, সরকারের ভাবমুর্তি ও সকল উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই, কোন একটা সুবিধাভোগী মহল সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবীকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাগ করার অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত রয়েছেন বলেও আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা মন্তব্য করেন । সুবিধাভোগের অপচেষ্টাকারীদের সংশোধন হওয়ার পরামর্শ দেন তারা।