জীবনের তাগিদে প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা জরুরি। আর এসব নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি মানুষের জন্য যেকোন পেশা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সবার জীবনে বড় বা মোটা বেতনের পেশা জুটেনা। তবে সৎ ভাবে আয় করলে কোন পেশাকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কারন পেশা মানেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে সেবার সামিল। এমনই এক বিচিত্র সেবামূলক পেশা লাশ টানার কাজে নিজেকে জড়িয়েছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার গড়েরগাঁও এলাকার শাহীদ ফরাজি। লাশটানা ভ্যানের চাকায় যেন ঘুরে তার সংসার।
তার আয়ের একমাত্র সম্বল এই লাশটানা ভ্যান। কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু, হত্যা বা দূর্ঘটনার মতো কোন অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই ভ্যান চালক শাহীদ ফরাজির ডাক পড়ে; শুরু হয় তার নির্ভীক কাজ। সে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ নিয়ে হাসপাতালে বা থানায়, পরে থানা থেকে জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে; এরপরে সকল ভয়ভীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ওপেক্ষা করে ডোমের কাটাছেঁডা লাশ পৌঁছেদেন নিহতের বাড়িতে। এভাবেই চলছে তার জীবন সংগ্রামের প্রায় একযুগ।
শাহীদ ফরাজি তার কাজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জানান, প্রায় একযুগ ধরে তিনি ভ্যানে লাশ টানার কাজ করছেন। এই কাজে এসে তার বিচিত্র ও তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। লাশ গলিত বা অর্ধগলিতই যাইহোক না কেন তা যেন শাহীদের কাছে আমানত। তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম লাশ টানতে ভয় লাগতো। একটু নির্জন স্থানে কিংবা আঁধার নামলে ভয়ে গা শিউরে উঠতো। এখন আর এমনটি হয় না।’ তবে শিশুদের লাশ টানতে গিয়ে সে আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেন, প্রায়ই তার চোখে জল এসে যায়। লাশের প্রতি তার দায়িত্ববোধ থেকে কোন কোন সময় লাশের পাশে বসেই তাকে রাত কাটাতে হয়। এমনকি ক্ষুধা লাগলে লাশের পাশে বসেই আহার করতে হয় বলে তিনি জানান।
তিনি আরো জানান, তার ভ্যান দিয়ে লাশ টানা হয় বলেই তাতে কোন মানুষ উঠেনা বা মালামাল পরিবহনে তার ডাক আসেনা। ফলে লাশ টানার কাজ না থাকলে তাকে কর্মহীন হয়ে বসে থাকতে হয়। তবে প্রতিমাসে গড়ে ৩-৪টি লাশ টানতে হয় তাকে। এসব লাশ টেনে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়েই কোনমতে ৬ সদস্যের সংসার চালাতে হয়। স্ত্রী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে তার সংসার-পরিবার। আভাবের সংসার হওয়ায় ছেলে মেয়েদের বেশি দূর পড়া লেখা করানোর সুযোগ হয়নি। অভাবের তাড়নায় বড় ছেলে (বয়স ২০ বছর) তার বাবার সাথে লাশ টানতে সহযোগিতা করতে চাইলেও শাহীদ তাকে এই সুযোগ নাদিয়ে মোটর গ্যারেজে কাজ শেখানো হচ্ছে বলে তিনি জানান। শাহীদ ফরাজি ভারাক্রান্ত মনে বলেন, অনেক সময় লাশ টেনে মজুরি পাইনি। অনেকে চুক্তির চেয়ে কম টাকা দেন। আবার বেওয়ারিশ লাশ কর্তব্যের তাগিদে ফ্রিতে বহন করতে হয়। তবুও লাশের খবর পেলে সবকিছু ভুলে ভ্যান নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে চলেন শাহীদ ফরাজি।
শাহীদের স্ত্রী বানেছা বেগম জানান, বিয়ের পর লাশ টানার কারণে ভয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে কয়েক বার পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। পরিবারের লোকজন ও স্বামীর কথায় আবার ফিরে আসতে হয়েছে। তবে সবাইকে একদিন মরতে হবে এবং অভাব থেকে রক্ষা পেতে হবে; এই চিন্তাধারা থেকে ধীরে ধীরে এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন আর ভয় করেনা তার। তিনি মনে করেন, তার স্বামী যদি অস্বাভাবিক মৃত্যু, হত্যা বা দূর্ঘটনার মতো কোন অপমৃত্যুর লাশ বা উদ্ধার করা লাশ না টানতেন তাহলে নিহতের পরিবারের লোকজনকে বিপাকে পড়তে হতো। সুতরাং তার স্বামী লাশ টেনে এক প্রকার সেবামূলক কাজ করছেন বলে তিনি মনে করেন।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ নকলা উপজেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মাহবুবুল আলম বিদ্যুৎ জানান, লাশ বাহক শাহীদের আর্থিক অবস্থা ভাল না। অভাব অনটনের মধ্যদিয়ে চলে তার সংসার। তাই তার এক মেয়ের পড়লেখার খরচ তিনি চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, শাহীদের মেয়েটি মেধাবী। তাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই চিন্তা থেকেই শাহীদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন অধ্যাপক মাহবুবুল আলম বিদ্যুৎ।
নকলা প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি মানবিক মানুষ খন্দকার জসিম উদ্দিন মিন্টু বলেন, শাহীদ প্রতিটি লাশের প্রতি দায়িত্বশীল ও ভাল মনের মানুষ। সে লাশ টানতে গিয়ে নিহতের পরিবারের লোকজনকে জিম্মি করে ভাড়া নিয়ে কারো সাথে দরকষাকষি করেন না। শাহীদের পেশা লাশ টানা হলেও তার বেশ কিছু গুণাবলীর কারনে সবাই তাকে অন্যান্যদের মতোই মূল্যায়ন করেন। শাহীদ নিজেও যেন একজন মানবিক মানুষ বলে মনে করেন জসিম উদ্দিন মিন্টু।
নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাদের মিয়া জানান, লাশ টানা পেশায় কেউ সহজে আসতে চায় না। পঁচা, দুগর্ন্ধ এমনকি বিকৃত নানা ধরনের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। সরকারি ভাবে এর কোন বেতন-ভাতাও দেয়া হয় না। তবুও লাশের খবর পেলেই শাহীদ ফরাজি হয়ে উঠে দায়িত্বশীল। শাহীদ জীবনের তাগিদে লাশের দায়িত্ব নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে থানায় বা হাসপাতালে, থানা থেকে জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে; এরপরে ডোমের কাটাছেঁডা লাশ নিয়ে সকল ভয়ভীতি ওপেক্ষা করে নিহতের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে শাহীদ ফরাজি। ওসি জানান, শাহীদ কয়েক ঘন্টাব্যাপী একটি লাশ পরিবহন করে গড়ে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা করে পায়। এছাড়া লাশ টানার পাশাপাশি বিভিন্ন মামলার প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা এবং প্রায়ই থানার ফুট ফরমায়েশও খেটে থাকে শাহীদ ফরাজি। তাই থানার কর্মকর্তাগন খুশি হয়ে মাঝেমধ্যে উপহার হিসেবে তাকে আর্থিক সহায়তা করেন। এসব মিলিয়েই তার সংসারের সব খরচ চলাতে হয় বলে ওসি জানান।
স্থানীয় অনেকে জানান, শাহীদের সৎ মা তার বাবার কাছ থেকে কৌশলে সব জমি রেজিষ্ট্রি করে নিয়ে তা সৎ ভাইদের দিয়েছেন। তাই সহায় সম্বলহীন শাহীদ বাধ্য হয়ে তার ছোট ভাই রাকিবের জায়গাতে ছোট একটি ঘর বানিয়ে সেখানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনক্রমে দিনাতিপাত করছেন। এমতাবস্থায় সরকারের কাছে একখন্ড জমিসহ প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি বসতঘরের আবদার মূলক দাবী জানিয়েছেন শহীদসহ স্থানীয়রা। জমিসহ একটি ঘর পেলে সেবামূলক বিচিত্র এই পেশার মানুষটি পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারতেন বলে অনেকে মন্তব্য করেন।