বৃটিশরাজ কর্তৃক বাজেয়াপ্ত গ্রন্থ গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গ্রন্থের নাম “শুভজাগরণ”, যার প্রকাশকাল ১৩২০ বঙ্গাব্দ। গ্রন্থটির লেখক মৌলবী খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী। এই নামটি প্রথম পাই আনোয়ারুল আলম শহীদের লেখা “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমার শ্রেষ্ঠ সময়” আত্মজীবনী মূলক বইতে, যে বই পড়ে জেনেছি লেখকের ব্যক্তিজীবনের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধে কাদের বাহিনীর অবিশ্বাস্য ও দুঃসাহসিক যুদ্ধকথা।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে পশ্চাদপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাগরণে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন মৌলবী খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী তাদের অন্যতম। তিনি ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, আরবি ও ফার্সি ভাষায় ছিলেন সুপণ্ডিত, তাঁর কর্ম জীবনও ছিলো বহুমাত্রিক; তিনি একাধারে রাজনীতিক, সমাজ হিতৈষী এবং সুলেখক ছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসনে অবনত, অতীতগৌরব বিলাসী, অলস নিস্ক্রিয়; যুগান্বয়ী বিদ্যাবুদ্ধি ও জীবন ভাবনায় বিমুখ মুসলমানদের জাগ্রত করার প্রয়াসে তিনি লিখেছেন “শুভজাগরণ” কাব্য। এই কাব্যে ২০টি দীর্ঘ কবিতা স্থান পেয়েছে। জাগরণ-ই কবিতার মূল সুর; আছে ঐতিহাসিক পরাজয়ের গ্লানি ও বেদনা, আছে নতুন জীবনের আহ্বান।
প্রধান কবিতা “জাগরে মুসলিম” থেকে অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি-
“কি ছিল মোসলেম কি হইল শেষে
ডুবাইল নাম হায় অপযশে
তোমরা মানব তোমরা অলস
আলস্যে শরীর করেছে অবশ,
নাই তোমাদের ঘৃণা লজ্জা রোষ
নাই তোমাদের কিছু মনস্তাপ।”
মুসলমানদের অসহায় দুর্গতি থেকে মুক্তির ও উন্নতির পথ খুঁজেছেন আধুনিক শিক্ষা ও কর্মযোগিতায়।তাই তাঁর কাতর মিনতি ও উদাত্ত আহ্বান- “উড়াও ভূতলে শিক্ষার নিশান আসিবে ফিরিয়া অতীত সম্মান/হবে অবসান ঘোর যামবতী।”
তিনি কৃষি শিক্ষা, শিল্পশিক্ষা, ব্যাংক গড়া এসব কর্মমুখী ও জীবন মুখী শিক্ষায় উৎসাহিত করেছেন; উপদেশমূলক কবিতায়। তার আধুনিক চেতনা উদার মানসিকতার পরিচয় পাই নারী শিক্ষার প্রতি সমর্থনে। “ললনা শিক্ষা” কবিতায় তিনি বলেন- যদি সুশিক্ষিত হন, মোসলেম ললনা কুল/ জ্বলিবে মোদের গৃহে সুখের বিমল আলো।” আরো বলেন “নামের মানব জাতি প্রকৃত মানব হবে।” শুধু আবেগ ও ভাবনায় নয় নারীর উন্নতিকল্পে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন। নিজ বাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে নারীর জন্য আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।
“শুভজাগরণ” গ্রন্থটি প্রকাশের পর মৌলবী আহমদ আলী আকালুবী তৎকালীন শাসকের রোষানলে পড়েন এবং বইটি বাজয়াপ্ত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই আত্মরক্ষার্থে লেখক মৌলবী আহমদ আলী আকালুবী পরিশেষে নিজ পিতৃভূমি টাঙ্গাইলের আকালু গ্রামতো বটেই, দেশত্যাগে বাধ্য হোন। এরপরে তাঁর সব সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়। পাঁচ বছর পরে ফিরে এসে বেদখল সম্পত্তি আর ফিরে পাননি। তাই নতুন বসতি গড়েন ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর অঞ্চলের বানেশ্বরদী গ্রামে, আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন।
মৌলবী খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবীর সহধর্মিনী মেহেরনেগার খাতুন গৃহকোণে শিক্ষা লাভকরে সাহিত্য চর্চা করতেন। তাঁর “অশ্রু প্রবাহ” কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৩২০ বঙ্গাব্দে। বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রিয়তম স্বামী মৌলবী খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবীকে।
উৎসর্গ বাণী উদ্ধৃত হলো- “যাহার যত্নবাহুল্যে আমার জ্ঞানালোক উদ্ভাসিত হইয়াছে আমার শিক্ষা দীক্ষা যাহার প্রসাদমূলক। যাহার পাদমূলে ধর্মতঃ আপনার জীবন যৌবন উৎসর্জন করিয়াছি, সেই সমাজ হিতৈষী স্ত্রী শিক্ষানুরাগী, স্বনামখ্যাত ইসলাম প্রচারক বঙ্গীয় মৌলভী ও কৃষক সম্মিলিত কনফারেন্সের জয়েন্ট সেক্রেটারী, শুভ জাগরণ ও মুসলমান ধর্ম বিধি প্রণেতা পতি দেব জনাব মৌলভী খন্দকার আহমাদ আলী আকালুবি সাহেবের পবিত্র করে আমার অশ্রু প্রবাহ উপহার প্রদান করিলাম।”
প্রতিগত প্রাণা-
মেহেরনেগার খাতুন।
উল্লেখ্য, মৌলভী আহমদ আলী আকালুবীও তাঁর কাব্য গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মেহের নিগার খাতুনকে। উৎসর্গ পত্রটি উদ্ধৃত করা হলো- “দুঃসময়ের পরম ন্যায় নিষ্ঠ স্নেহময়ী সহধর্মিনী শ্রীমতি মেহের নিগার খাতুনের হস্তে শুভ জাগরণ উপহার প্রদান করিলাম।”
শতাব্দী পূর্বের কবি দম্পত্তির কাব্য দুটি প্রকাশ করে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, পূর্বপ্রাক্তনের ঋণ শোধ করেছেন অধ্যাপক তাসলিমা বেগম (সাবেক চেয়ারম্যান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা)। মৌলভী খন্দকার আহমদ আলী আকালুবি এবং মেহের নিগার খাতুন তার পিতামহ ও পিতামহী।
# লিখেছেন: সাহিত্য আলোচক ড. অধ্যাপক আয়েশা বেগম (সভাপতি- বাংলা ভাষা পর্ষদ) ও সাবেক অধ্যক্ষ, ঢাকা কলেজ।