আমরা সাধারণত পোকা-মাকড়কে ভয় পাই। যে কোনো পোকা দেখলেই আমরা তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলি। কিন্তু পরিবেশে বিচরণশীল সব পোকাই ক্ষতিকর নয়। অনেক প্রজাতির পোকা আছে, যা বেশ উপকারী। এমন একটি উপকারী পোকা হলো বিটল পোকা।
বর্তমানে দেশের সর্বত্রই হাঁস-মুরগি-কবুতরের বিকল্প খাদ্য হিসেবে বিটল পোকা ব্যবহারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাজারে প্রচলিত ফিডের দাম তুলনামূললক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিটল পোকার ব্যবহার শুরু করেছেন খামারিরা। এতে করে লাভবান হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিরা।
হাঁস, মুরগি ও কবুতরের প্রচলিত ফিডের তুলনায় বিটল পোকা উচ্চ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি প্রাকৃতিক খাবার। হাঁস, মুরগি ও কবুতরসহ গবাদী পশুর ৬০ ভাগ থেকে ৭০ ভাগ প্রোটিনের চাহিদা পূরন করতে পারে এই পোকা। তাই এই খাবারটি পোল্ট্রি খামারিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষীরা এই উপকারী পোকার চাষ শুরু করেছেন। এমন একজন চাষী হলেন শেরপুরের নকলা উপজেলার শাখাওয়াত হোসেন ফারুক।
ফারুকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফারুক যে কৃষি খামারের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন সেটি মূলত উপজেলার মো. শামীমুজ্জামান মিঠুর নিজস্ব খামার। এই খামারে বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দেশি-বিদেশী বিভিন্ন উন্নত জাতের হাঁস, মুরগি ও কবুতর লালন পালন করা হয়। এসব হাঁস, মুরগি ও কবুতরের জন্য প্রচলিত ফিড ব্যবহার করা হয়। এতে বেশ টাকা ব্যয় হয় ও সময় লাগে বেশি। কিন্তু বিটল পোকা খাওয়ালে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ প্রোটিনের চাহিদা পূরন হয়ে যায়। পাশাপাশি স্বাভাবিকের তুলনায় উৎপাদন বাড়ে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। এতে উৎপাদন খরচ ও সময় উভয়ই বাঁচে, কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ। তাই দিন দিন এই উপকারী পোকার চাহিদা বাড়ছে।
তিনি জানান, এই পোকা বাড়ির যেকোন জায়গায় সহজে লালন পালন করা যায়। এই পোকা হাঁস, মুরগি ও কবুতরকে সরাসরি খাওয়ানোর পাশাপাশি সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটিকে পাউডার তৈরী করেও হাঁস-মুরগিকে খাওয়ানো যায়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন খামার থেকে প্রতি কেজি বিটল পোকার পাউডার ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে এটি সারাদেশে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়নি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।
ফারুক তার লালন পালন করা বিটল পোকার বিষয়ে জানান, ২০২১ সালের মাঝামাঝির দিকে ময়মনসিংহ থেকে প্রতিটি বিটল পোকা ২৫ টাকা দরে ২৫০টি বিটল পোকা নিয়ে তার যাত্রা শুরু। তার খামারের হাঁস মুরগিকে খাওয়ানোর পরেও বর্তমানে তার সংগ্রহে ৩৮টি বক্সে ২০ হাজারেরও বেশি বিটল পোকা রয়েছে; এরমধ্যে হাজার খানেক মাদার পোকা রয়েছে। বিটল পোকা ব্যবহারে পোল্ট্রি উৎপাদনের খরচ অনেক কমে গেছে বলেও তিনি জানান। তাই দিন দিন উচ্চ প্রোটিন যুক্ত খাদ্য হিসাবে বিটলের ব্যবহার বাড়ছে। অল্প খরচে এই পোকা উৎপাদন করে হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবারের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
বর্তমানে মৎস্য, পোল্ট্রি ও হাঁস-মুরগি পালনের প্রধান অন্তরায় খাদ্য ব্যয় ও রোগবালাই। প্রায় প্রতিটি খামারের ৮০ ভাগ ব্যয় হচ্ছে খাদ্যের পেছনে। তারপরও গুণগতমান সম্পন্ন খাদ্যের ব্যাপক সংকট রয়েছে। উচ্চমূল্যে পোল্ট্রি খাদ্য কিনতে হচ্ছে। মূলত এজন্যই অধিকাংশ খামারিদের প্রায়ই লোকসান গুণতে হয়। তবে এখন আর হাঁস, মুরগি, কবুতর, পাখি ও মাছের প্রোটিনের অভাব নিয়ে কারো চিন্তা নেই। খুব কম খরচে সহজেই অভিনব পদ্ধতিতে বিটল পোকার চাষ করা হচ্ছে।
মাদার বিটল পোকা একসাথে অগণিত ডিম দেয় এবং দীর্ঘ ৮মাস ব্যাপি। এসব ডিম ফুটে লার্ভা হয়। লার্ভা বড় হলে সেগুলোকে বিটল পিউপা মাদার সেলে স্থানান্তর করা হয়। মাদার সেল মূলত একটি প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম ছোট গ্লাস। পিউপা থেকে মাদার বিটলে রূপান্তরিত হয়, যার রং হয় লাল। ৩দিনের মধ্যে লাল রং পরিবর্তন হয়ে কারো রং ধারন করে। এর পরেই কালো মাদার বিটল পোকা গুলো ডিম দেওয়া শুরু করে। লার্ভা ও মাদার বিটলকে খাদ্য হিসেবে সাধারণত সহজ লভ্য কাঁচা পেঁপে, মিষ্টি লাউ, বাঁধা কপি দিতে হয়। অতি উপকারী বিটল পোকা লালন পালনে কিছু পরিচর্যা, সহজ লভ্য সামান্য পরিমাণ খাবার দেওয়া, সল্প মূল্যের প্লাস্টিকের বক্স ও ডিম পাড়ার সুবিধার্থে কিছু গমের ভূষি ছাড়া বাড়তি কোন খরচ করতে হয়না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল ওয়াদুদ বলেন, এই পোকা চাষে কোনো ময়লা ও দুর্গন্ধ হয় না। বিটল পোকা উড়তে পারে না, তাই নেটের ভেড়া দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, নেই কোন বাড়তি খরচ। এই পোকা হাঁস, মুুরগি, কোয়েল পাখি, লাভ বার্ড ও মাছের খাদ্যে প্রোটিনের ৭০ ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। যে কোন শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবনারী অল্প পুজিঁ দিয়ে উন্নত জাতের কিছু হাসঁ-মুরগি লালন পালন করে এবং বাড়িতে বিটল পোকা চাষ করে তাদিয়েই তার হাঁস মুরগির খাদ্যের চাহিদা মিটাতে পারেন। এতেকরে একদিকে খরচ কমবে, পক্ষান্তরে উৎপাদন বাড়বে। হাঁস, মুরগী, কোয়েল পাখি, লাভ বার্ড ও মাছের খাদ্যের জন্য নিজ নিজ বাড়িতে বিটল পোকা লালন পালন করে খরচ বাঁচিয়ে যেকেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।