আজ ৭ ডিসেম্বর, শেরপুর ও নালিতাবাড়ী অঞ্চল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুর ও নালিতাবাড়ী অঞ্চলকে পাকিস্তানি শক্রর হাত থেকে মুক্ত করা হয়। দেশের সীমান্তবর্তী এ জেলার প্রথম শক্রমুক্ত হয় ৪ ডিসেম্বর ঝিনাইগাতী, এর পরে ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় শ্রীবরদী অঞ্চল। ঠিক এর পরের দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা হয় শেরপুর ও নালিতাবাড়ী অঞ্চলকে। সর্বশেষ বর্তমান শেরপুর জেলার নকলা অঞ্চল পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর।
শেরপুর:
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য মতে জানা গেছে, এ দিন মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে হেলিকপ্টারযোগে এসে এক সমাবেশে শেরপুরকে মুক্ত বলে ঘোষণা দেন। এই দিন মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে হেলিকপ্টারযোগে এসে নামেন এবং এক স্বতস্ফূর্ত সমাবেশে শেরপুরকে মুক্ত বলে ঘোষণা দেন। পরে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের শেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান জানান, মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে বর্তমান শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৩০ থেকে ৪০টি খণ্ডযুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে ৫৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন, শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী গ্রামে ৩৯ জন এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ৪১ জন শহীদ হন। তিনি আরও জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর শহরে প্রবেশ করে। বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি গড়ে তোলে। শেরপুর জেলা শহরের নয়ানী বাজারে টর্চার সেল ও ঝিনাইগাতী উপজেলার আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ঘাঁটিতে চালায় অমানবিক অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ। অন্যদিকে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আঘাত হানতে থাকে শত্রু শিবিরে। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শত্রু বাহিনীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে থাকে। ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের বেশ কয়েকবার কামালপুর দুর্গে আক্রমণ চালান। ১১ দিন অবরোধ থাকার পর ৪ ডিসেম্বর এই ঘাঁটির পতন হয়। মোট ২২০ জন পাকিস্তানি সেনা এবং বিপুল সংখ্যক রেঞ্জার, মিলিশিয়া ও রাজাকার বিপুল অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। কামালপুর মুক্ত হওয়ার পর হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় শেরপুরে হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। কামালপুর দুর্গ দখল হওয়ার প্রায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর সকল ক্যাম্প ধ্বংস হয়। তারা ৬ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জামালপুর পিটিআই ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এরপর ৭ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় শেরপুর অঞ্চল।
নাীলতাবাড়ী:
পাকহানাদার বাহিনী বর্তমান নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদ, রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট অফিস, হাতিপাগার বিডিআর ক্যাম্প তিনআনী বাজার ও ঝিনাইগাতির আহাম্মদ নগরে ক্যাম্প স্থাপন করে। দীর্ঘ ৯ মাসে নাকুগাঁও (বর্তমান স্থলবন্দর) ঢালু সীমান্তে ২৫মে ভোরে পাকিস্তানী হায়েনার দল অতর্কিত হামলা চালিয়ে ৯ জন ভারতীয় বিএসএফসহ কয়েকশ বাংলাদেশিকে নির্মম ভাবে হত্যা করে পাশের ভোগাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ৩০ জুন তন্তর গ্রামের সাত জনকে হত্যা করে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। নন্নীবারমারী সড়কে একজন ক্যাপ্টেনসহ ছয়জন সৈন্য জিপ দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনী আতংকিত হয়ে পড়ে। শেষে কৌশল পরিবর্তন করে নালিতাবাড়ী থানা সদরে রাজাকার আল বদরদের সহায়তায় শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর ২৫ জুলাই উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন নারী-পুরুষ শিশুসহ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
পহেলা ডিসেম্বর এ ঘাঁটি থেকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান চালালেও সফল হতে পারেনি। বরং হাছেন আলী মুন্সি ও আয়াত আলী নামে দুই জন মুক্তিযোদ্ধা শাহিদ হন। রাজাকার আলবদররা এ দুই বীরের মরদেহ নিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। তাদের পায়ে রশি বেঁধে টেনে শহরের অদূরে নিয়ে মাটি চাপা দেয়। ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে পুনরায় ক্যাম্প দখলের লড়াই শুরু হয়। এ লড়াইয়ে মিত্রবাহিনীর একটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল অংশ নেয়। টানা দুইদিন দুইরাত গুলাগুলি চলার পর ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোম্বিং করার পরিকল্পনা করে। এতে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির কথা চিন্তা করে এ পরিকল্পনা বাদ করা হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা আক্রমণ শিথিল করে দেন। এ সময় ক্যাম্পের আলবদর, রাজাকাররা পালিয়ে যায়। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর পূর্বদিগন্তে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা, জয়বাংলা– স্লোগানে এলাকায় ঢুকতে থাকে। ক্রমেই স্লোগানের আওয়াজ স্পষ্ট হয় কেটে যায় শঙ্কা। মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে মুক্তির উল্লাসে মেতে ওঠেন এলাকার মুক্তিকামী সাধারন জনগন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীরা এগিয়ে যায় সামনের দিকে পিছু হটে হানাদার বাহিনী। শত্রু মুক্ত হয় নালিতাবাড়ী অঞ্চল। উড়নো হয় লাল সবুজের পতাকা।