শস্য ভান্ডার খ্যাত শেরপুরের নকলা উপজেলার মাটি সব ধরনের ফল ও ফসল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। মাটি ও আবহাওয়া কমলা চাষের উপযোগি বিবেচনায় উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের চকবড়ইগাছি এলাকার আবু বক্করের ছেলে কলেজ পড়ুয়া রাকিবুল হাসান ২০২০ সালের শেষের দিকে ময়মনসিংহ থেকে চায়না জাতের ৩০টি চায়না কমলা গাছের চারা এনে বাড়ির পাশের এক খন্ড জমিতে রোপন করেন।
ইউটিউব দেখে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক ও সৌখিন চাষীদের সফলতা দেখে রাকিবুল হাসান চায়না কমলা চাষের দিকে ঝুঁকেন। শখের বসে চায়না কমলা চাষ করে, আজ তিনি সবার কাছে সফল কমলা চাষীর সুনাম অর্জন করছেন।
হঠাৎ করে তার ব্যতিক্রমী চাষাবাদের ইচ্ছা জাগে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন চায়না কমলার বাগান করার। সিদ্ধান্তের কথা পরিবারের সদস্যদের জানালে কেউই একমত হননি। কারণ নতুন এই ফল চাষে কতটুকু সফলতা আসবে তা নিয়ে সবাই দ্বিধান্বিত ছিলেন।
পরিবারের সদস্যদের বাধাসহ নানা বাধা পেরিয়ে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ নিয়েই তিনি কমলাগাছ রোপণ করেছিলেন। মাত্র আড়াই বছরের মাথায় গাছে থোকা থোকা কমলা ধরেছে। প্রত্যাশার চেয়ে ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকদের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও এ অঞ্চলে চায়না জাতের কমলা চাষে অপার সম্ভাবনা দেখেছেন।
এই অঞ্চলের মাটিতে যে চায়না কমলা হবে তা নিয়ে সংশয় কেটে গেছে। প্রতিটি গাছে প্রত্যাশার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ফল এসেছে। একেকটি গাছ দেখলে যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। যখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন রাকিবুলের চায়না কমলা বাগান দেখতে আসে তখন ছেলেকে সফল কৃষক মনে হয় বলে জানান রাকিবুল হাসানের বাবা আবু বক্কর।
রাকিবুল হাসানের সফলতা দেখে এলাকার অনেকে চায়না কমলা চাষে আগ্রহী হয়েছেন। বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত বেশি আগ্রহী হয়েছেন। তাছাড়া সৌখিন চাষীরাও শখ করে বাড়ির আঙ্গিনায় চায়না কমলা চাষে ঝুঁকছেন।
চাকরি না পাওয়ায় পরিবারের প্রয়োজনে রাকিবুল হাসান গত ৫ মাস আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। বর্তমাতে তার শখের কমলা বাগানটি তার বাবা আবু বক্কর দেখভাল করেন। বাবা-মাসহ পরিবারের যে লোক গুলো চায়না কমলা চাষে প্রথমে তাকে বাধা দিয়েছিলেন, আজ সফলতা দেখে তারাই ওই বাগানের দেখভালসহ সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাকিবুল হাসানের অনুপস্থিতিতে বাগানের মূখ্য তত্বাবধায়ক তার বাবা আবু বক্কর কমলা বাগানে সেচ দিচ্ছেন। আবু বক্কর বলেন, প্রথম দিকে ছেলের কমলা বাগানের বিষয়টি আমিসহ পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু তার আগ্রহের কাছে আমরা সবাই পরাস্ত হই। অবশেষে সে ঠিকই চায়না কমলার বাগান করে। এক বছরের মাথায় ২০২১ সালে বেশ কয়েকটি গাছে ফুল-ফল আসে। ফল পরিপক্ক হলে খেতেও বেশ ভালো লাগে। এদেখে আমরা বাগানে শ্রম দিতে আর বাধা নাদিয়ে বরং বাগানের কাজে তাকে সহযোগিতা করতে থাকি। এতে সে খুশি হয়ে বাগানের সেবা বাড়িয়ে দেয়। পরের বছর ২০২২ সালে প্রায় প্রতি গাছে ব্যাপক ফলন হয়। তবে মাটির কারনে সামান্য টক হওয়ায় কমলার ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে তিনি জানান। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি কমলা পাইকারি দাম গড়ে ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি গাছে এতটাই ফলন হয়েছে যে, না দেখলে বিশ্বাস করার নয়।
আবু বক্কর জানান, গত বুধবার একটি গাছ থেকেই পরিপক্ক ৪০ কেজি কমলা সংগ্রহ করেছেন। ওই গাছে আরো অন্তত ৩০ কেজি থেকে ৪০ কেজি কমলা রয়েছে। প্রায় প্রতিটি গাছেই এমন ফলন হয়েছে। তার হিসেব মতে এবছর বাগানের ৩০ টি গাছে কমপক্ষে ৫০ মণ থেকে ৫৫ মণ কমলা হয়েছে। প্রতি মণ কমলা পাইকারি ২,২০০ টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে এবছর ৩০ টি গাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় হবে বলে তিনি আশাব্যক্ত করেন।
তিনি আরো জানান, কমলা গাছ থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করার মতো লোক পরিবারে না থাকায় বাধ্য হয়েই পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকাররা নিজে বাগান থেকে কমলা সংগ্রহ করে নেয়, তাই কমলার দাম থেকে মজুরি বাবদ শ্রম মূল্য কাটার কারনে তিনি দাম কিছু কম পাচ্ছেন বলে আবু বক্কর জানান।
বাগান থেকে সতেজ কমলা কিনতে আসা বন্দটেকি এলাকার কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী সিমানুর রহমান সুখন জানান, এলাকার অনেকেই কমলা বাগানের বিষয়টি জানেন না। যারা জেনেছেন তারা সরাসরি বাগানে এসে কমলা কিনে নিয়ে যায়। বাগান থেকে কমলা কিনলে সঠিক ওজনে ও সাশ্রয় মূল্যে পাওয়া যায়। তাই আমিসহ অনেকে সরাসরি বাগানে এসে বাগান মালিকের কাছ থেকে কমলা কিনি। তিনি বলেন, এখানের কমলা মাটির ধরনের জন্য সামান্য টক হলেও কমলা গুলো আকারে বেশ বড় ও রসালো। এখানকার উৎপাদিত কমলা সামান্য টক হলেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে বলে তিনি মনে করছেন। এসব এলাকায় এত সুন্দর ও ভালো মানের কমলা উৎপাদন হবে তা আমি কল্পনাই করতে পারিনা।
ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছাইদুল হক ও সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন জানান, নকলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চায়না কমলা চাষ ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষি ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে। পাশাপাশি সরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতা পেলে অন্য কৃষকরা কমলা চাষে এগিয়ে আসবেন বলে তারা মনে করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, নকলা মাটি ও আবহাওয়া যেকোন ফল ও ফসলের জন্য উপযোগি। এখানে যেকোন ফসল ফলানো ও ফলের বাগান করে সফলা পাওয়া সম্ভব। তিনি জানান, জৈব সার প্রয়োগ করেই কমলার ভালো ফসল পাওয়া যায়। পাতায় পোকার আক্রমণ হলে সামান্য পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। আর যেসকল এলাকার কমলা কিছুটা টক, সেসকল এলাকার কমলা বাগানের প্রতিটি গাছের গুড়ার চার পাশে ড্রেন করে সেখানে পটাশ ও বোরন ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে। ফলন শুরুর বছর প্রতি গাছ হিসেবে ১২০ গ্রাম পটাশ ও ২০ গ্রাম বোরন মিশিয়ে দুই ভাগ করে বছরে দুই বার গাছের গুড়ার চার পাশে ২ থেকে আড়াই ফুট দূর দিয়ে ব্যবহার করলে টক ছেড়ে যাবে। দিন দিন গাছ বড় হবে, তাই প্রতি বছর পটাশ ১০০ গ্রাম করে ও বোরন ১০ গ্রাম হারে বাড়িয়ে ব্যবহার করতে হবে।
তবে চায়না জাতের কমলা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করাটাই উত্তম, কারন হিসেবে কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, এতে করে পাইকাররা সরাসরি এসে নিয়ে যাবেন। কমলার পরিমাণ কম হলে পাইকাররা আসতে চাইবেন না। কমলা চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষিক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। কমলার স্বাদ মানুষ নিজের দেশ থেকেই পাবে। কমলা চাষে খরচ অত্যন্ত কম। তাই এটা চাষে বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। অপার সম্ভাবনাময় চায়না জাতের কমলার চাষ বাণিজ্যিকভাবে দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে দেশের কৃষক। অন্যদিকে, পুষ্টি চাহিদা পূরণে বিরাট ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি ইঞ্চি জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এতেকরে কিছুটা হলেও কমবে বেকারত্ব, বাড়বে স্বাবলম্বীর সংখ্যা, পাশাপাশি সমৃদ্ধ হবে কৃষি অর্থনীতি; এমনটাই মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট অনেকে।