শেরপুর জেলার নকলা উপজেলা মৌসুমি কাঁচা ফল উৎপাদনে জেলার সেরা হিসেবে খ্যাতি অর্জনের পথে। নকলার উৎপাদিত বিভিন্ন মৌসুমি ফল রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে প্রেরন করে যে লাভ হয়, তা দিয়েই চলে উপজেলার অর্ধশতাধিক পরিবারের মৌসুমি ফল বিক্রেতার ছেলে মেয়দের পড়ালেখার খরচসহ চলে সংসারের ব্যয়। গ্রামের মৌসুমি ফল শহরে বিক্রি করে লাভের টাকায় তাদের সংসার চালায়।
তার সাধারনত গ্রামে গ্রামে ঘুর জলপাই, আম, জাম কাঠাঁল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আমড়া, জাম্বুরা, তেঁতুল, বেল, আমলকী, কদবেল ও নারিকেলসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল মৌসুমের শুরুতেই কৃষকদের কাছ থেকে গাছচুক্তি হিসেবে কিনে রাখেন। পরে বিক্রির উপযোগী হলে তা সংগ্রহ করে বাছাই করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিক্রি করেন।
এখানের ফল অপেক্ষাকৃত বড়, সুন্দর ও সুস্বাদু হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নকলার ফলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রায় প্রতিদিন কয়েক ট্রাক মৌসুমি ফল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে যাচ্ছে। মৌসুমি ফল বিক্রি তথা এই ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন উপজেলার অর্ধশত পরিবার। তারা এই মৌসুমি ফলের ব্যবসা করেই তাদের সংসার ও ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচ বহন করেন।
এমন ব্যবসায়ীর মধ্যে চরকৈয়া এলাকার আব্দুল বারেকের ছেলে মোজাম্মেল হক, হযরত আলীর ছেলে রফিকুল ইসলামসহ করিম মিয়া, সাদ্দাম হোসেন, বাবুল মিয়া ও কব্দুল আল ও শহিদুল; জালালপুরের আব্দুল মিয়া, কব্দুল আলী, তারা মিয়া, মস্তু মিয়া, শহিদুল ইসলাম, রতন, আশরাফ আলী, তারা মিয়া, হলকু মিয়া, দুদু মিয়া ও আনার মিয়া; কায়দা এলাকার আবুল মিয়া, গেন্দুক ও রহুল আমিন; সাহাপাড়া এলাকার রুপচাঁন, ধনাকুশা এলাকার আসাদুল, কবুতরমারীর এলাকার হরমুজ আলী, মো. হরু মিয়া ও নকলার লম্বু মিয়াসহ উপজেলার ৫০ থেকে ৬০ টি পরিবার এ ব্যবসার সাথে জড়িত।
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা সারা বছর বিভিন্ন মৌসুমি ফলের ব্যবসা করেন। মৌসুমের শুরুতেই তারা বাড়ী বাড়ী ঘুরে অগ্রীম টাকা দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে মালিকদের কাছে গাছের ফল চুক্তি হিসেবে কিনে রাখেন। সময় হলে তথা পরিপক্ক হলে ওইসব ফল সংগ্রহ করে বিভিন্ন জেলাসহ রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করেন তারা। তারা মাসে অন্তত ১০ থেকে ১২ বার ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে কাঁচা ফল চালান দিতে বা প্রেরণ করতে পারেন।
তাদের দেয়া হিসেব মতে, বছরে ১২০ থেকে ১৪৪ বার কাঁচা ফল পাঠাতে পারেন তারা। প্রতিচালানে এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা করে তাদের লাভ থাকে। এতে করে প্রতি পাইকারের প্রতি বছর ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা করে লাভ হয়। এ লাভের টাকাতেই তাদের সারা বছরের সংসার খরচ ও সন্তানদের শিক্ষা খরচ চলে।
মৌসুমি কাঁচা ফল ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক জানান, তিনি ৮ বছর ধরে এই ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন। চলতি মৌসুমে তিনি ৬০ হাজার টাকায় ৫৫ টি জলপাই গাছ কিনেছেন। জলপাই বিক্রি চলবে ৪৫ থেকে ৬০ দিন। এই দেড়-দুই মাসে তার অন্তত ৫০ হাজার টাকা লাভ বলে বলে আশা করছেন। তারা প্রথমে জলপাই গাছ থেকে সংগ্রহ করে ছোট ও বড় বাছাই করে তা বস্তাবন্ধি করেন। প্রতি বস্তায় ১২০ কেজি করে জলপাই ভরেন। ছোট সাইজের জলপাই প্রতি বস্তা এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা করে এবং বড় সাইজের জলপাই প্রতি বস্তা ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
অন্য এক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, মৌসুমী ফলের ব্যবসার আয় দিয়েই জীবন জীবীকা নির্বাহ করেন তারা। সে ১০ বছর ধরে এ ব্যবসা করছেন। ফলের প্রতিটি মৌসুমে অন্তত ১০ থেকে ১৫ টি চালান দিতে পারেন তিনি। তিনি আরো জানান, প্রতি চালানে তাদের কিনা দামের ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মাল যায়। এগুলো বিক্রিতে যা দিয়ে কিনা হয়েছিলো, প্রায় তার সমান লাভ হয়। কিন্তু পরিবহণ ব্যয়, ফল সংগ্রহের শ্রমিক ও ফলের মালিকের খরচ বাদে প্রতি চালানে লাভ থাকে ১ হাজার ৫০০ টাকা থকে দুই হাজার টাকা করে।
জলপাই গাছের এক মালিক সুফিয়া বেগম জানান, তার দুটি গাছ মৌসুমের শুরুতে ৫,২০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এই টাকাতেই তার দুই ছেলে-মেয়ের সারা বছরের খাতা, কলম কেনার খরচ হয়ে যাবে। প্রতি বছর তিনি জলপাই বিক্রির টাকায় ছেলে-মেয়ের খাতা, কলম কিনে দেওয়াসহ অন্যান্য কাজেও ব্যয় করতে পারেন। অন্য এক কৃষক কব্দুল হোসেন জানান, মৌসুমের শুরুতে একসাথে টাকা পাওয়ায় তা সংসারের বেশ কাজে লাগে। ব্যবসায়ীরা চুক্তিতে না কিনলে নিজেরা গাছ থেকে জলপাই সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতে গেলে লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হতো।
মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীরা দাবি করে জানান, সরকার যদি তাদের জন্য সহজ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতেন, তাহলে তাদের দেখাদেখি অনেকেই এই ব্যবসার প্রতি ঝুঁকতেন। এতে উপজেলার অনেকে আত্ম নির্ভরশীল হওয়ার পথ খোঁজে পাবেন, হতেন স্বাবলম্বী। ফলে কিছুটা হলেও বেকারত্ব কমত বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দসহ অনেকে।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুর ওয়াদুদ জানান, নকলা উপজেলার মাটি আম, জাম কাঠাঁল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, জলপাই, আমড়া, জাম্বুরা, তেঁতুল, বেল, আমলকী, কদবেল ও নারিকেলসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। উপজেলায় অগণিত ফলদায়ী গাছ রয়েছে। এসব গাছের ফল অন্যান্য জেলায় যথেষ্ট কদর রয়েছে। তিনি বলেন, যেকেউ ফলের বাগান করে ও মৌসুমি ফলের ব্যবসা সহজেই স্বাবলম্বী হতে পারেন। ফল চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তাদেরকে কৃষি অফিস থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে। ফল চাষের পরিমান বাড়াতে কৃষকদের জন্য আলাদা সেবার ব্যবস্থা করা হবে বলে কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুর ওয়াদুদ জানান।