শেরপুর জেলার নকলা উপজেলাধীন ধুকুড়িয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যুৎ। বর্তমানে তিনি হাঁসের খামার থেকে মাসে যে আয় করছেন, তা বেসরকারি কলেজের এমপিও ভুক্ত একজন অধ্যাপকের বেতনের চেয়ে অনেক বেশি।
তিনি হাঁসের খামার করে প্রমান করেছেন উচ্চ শিক্ষিত হলেই যে চাকরি করতে হবে এমন ধারনা সঠিক না। কঠোর পরিশ্রম আর প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো কাজে যেকেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন এমনটাই প্রমাণ করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যুৎ।
অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যুৎ জানান, আগে এমপিও ভূক্ত অধ্যাপক হিসেবে তিনি যে সম্মানি পেতেন তাদিয়েই তার সংসার ও ছেলে-মেয়েদের পড়া লেখার খরচ চালাতেন। কিন্তু চাকরির শেষের দিকে এসে তিনি অনেকটাই চিন্তায় পরেযান। আয়ের কোন নতুন উৎস না হলে কিভাবে চলবে সংসার! ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচইবা কেননে চলবে! এমনসব চিন্তা যেন তাকে ঘিরে ফেলে। ঠিক এমনসময় ইউটিউবে বেকার যুবক-যুবনারীসহ বিভিন্ন এলাকার হাঁস খামারিদের সফলতার খবর দেখে সিদ্ধান্ত নেন চাকরি শেষে তিনিও হাঁসের খামার করার। সিদ্ধান্ত মোতাবেক চাকরি শেষ হওয়ার আগের বছর তথা ২০২০ সাল থেকেই তিনি হাঁসের খামারের কাজ শুরু করেন। ওই বছর ৫০০ হাঁস দিয়ে তার খামারের যাত্রা শুরু হয়। ৬০ ভাগ হাঁেসর ডিম দেওয়া শুরু হলে তার স্ত্রী সৈয়দা বেগম লবিবা করোনা পজেটিভ হয়। তার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হলে তাকে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে মাহবুবুর রহমান বিদ্যুতের অবস্থান করা জরুরি হওয়ায় বাধ্য হয়েই হাঁস গুলো বিক্রি করে দিতে হয়। এতেকরে তার আসল উঠে আসে। উৎপাদনের মাঝ সময় খামার ছেড়ে দেওয়ার পরেও লোকসান না হওয়ায় ও তার স্ত্রী সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসলে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন বড় পরিসরে হাঁসের খামার করবেন। ২০২১ সালে জুলাই মাসে তিনি অবসরে এসে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২২ সালের মে মাসে ভারতীয় জেন্ডিং জাতের এক হাজার হাঁসের বাচ্চা দিয়ে বড় পরিসরে খামার করার কাজ শুরু করেন। সরকারি হাঁস প্রজনন কেন্দ্রে থেকে জিরো সাইজের প্রতিটি বাচ্চা ৩০ টাকা করে কিনে আনেন তিনি।
এর আগে হাঁস গুলোকে রাতে রাখার জন্য টিন শেড বড় ঘর নির্মাণ করেন, হাঁসের গোসলের পানি সরবরাহের জন্য বৈদ্যুতিক পাম্প স্থাপন করারর পাশাপাশি পাম্পের সাথেই পাকা হাউজ তৈরি করেন। তাছাড়া দিনের বেলায় হাঁস রাখা ও খাবার দেওয়ার জন্য নির্মান করেন ঢালু পাকা মাঠ। এতে ৩ লাক্ষাধিক টাকা তার ব্যয় হয়। এছাড়া হাঁসের বিষ্টা মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহারের সুবিধার্থে খামারের পাশেই ৩০ শতাংশ জমিতে পুকুর খনন করেন। হাঁসের বিষ্টা পুকুরের মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করায় মাছের জন্য আলাদা খাবার দিতে হয়না। এতে করে হাঁসের খাবারেই মাছের খাবারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।
তিনি জানান, বর্তমানে তার খামারের এক হাজার হাঁসের মধ্যে ৯৩ টি মর্দা রয়েছে। বাকি গুলোর মধ্যে ৫৫০ থেকে ৫৮০ টি হাঁস আপাতত ডিম দিচ্ছে। এতে ডিম থেকে প্রতিদিন আয় হচ্ছে ৭ হাজার থেকে ৭ হাজার ৫৪০ টাকা। প্রতিদিনই ডিম দেওয়া হাঁসের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে আয়ও বাড়ছে বলে তিনি জানান। তার খামারের সবকয়টি মাদী হাঁস বছরে অন্তত ৭ মাস ডিম দিলে বছরে তার আয় হবে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা।
খামারী বিদ্যুৎ বলেন, তার খামারে কাজের জন্য ২ জন শ্রমিক রাখা হয়েছে। তাদের দুই জনের মাসিক মজুরি ১১ হাজার ৫০০ টাকা। শ্রমিকরাই হাঁসের খামার ও পুকুরের সব কাজ করে। আমি নিয়মিত দেখভাল করি ও দিকনির্দেশা দেই মাত্র। তবে প্রতিদিন কিছু কিছু কায়িক পরিশ্রম করি। তাতে একদিকে যেমন শরীর সুস্থ্য থাকছে, মন থাকছে প্রফুল্ল; অন্যদিকে শ্রমিক ব্যয় কিছুটা হলেও কম লাগতেছে। এবছর ঘর নির্মানসহ খামারের অন্যান্য জরুরি কাজ, শ্রমিক মজুরি, হাঁসের খাবার, বৈদ্যুতিক বিলসহ সব খরচ বাদেও বছরে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা তার লাভ হবে বলে তিনি আশা করছেন। যা কলেজের এমপিও ভুক্ত একজন অধ্যাপক হিসেবে এই আয় ছিলো কল্পনার বিষয়।
বিদ্যুৎ আরো জানান, তিনি হাঁসের খামার করার আগে দেশের বিভিন্ন এলাকার লাভজনক অন্তত ১২ টি হাঁসের খামার পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। অর্জিত এ অভিজ্ঞতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে তিনি আজ কলেজের এমপিও ভুক্ত একজন অধ্যাপকের বেতনের চেয়ে অনেক বেশি আয় করছেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি শিক্ষিত বেকার ও অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আজ অনুকরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। একজন লোক তার মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা মোতাবেক কোন কাজ করলে তাকে চাকরির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবেনা বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, যে কোনো বেকার নারী-পুরুষ হাঁস পালনে এগিয়ে এলে তাকে সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সহজ কিস্তিতে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এতে করে কিছুট হলেও বেকারত্ব কমবে, বাড়বে কর্মসংস্থান, সমৃদ্ধ হবে কৃষি অর্থনীতি।
উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ড. ইসহাক আলী জানান, শিক্ষিত হলেই যে চাকরি করতে হবে এ ধারনা মোটেও সঠিক না। কঠোর পরিশ্রম আর প্রয়োজনীয় পরিকল্পানা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যেকেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন। আর এর উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যুৎ। তার দেখাদেখি উপজেলার অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবনারী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাঁস-মুরগী ও গরুর খামারের দিকে ঝুঁকছেন বলে তিনি জানান। এসব খামারীদের নিয়মিত পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ড. ইসহাক আলী।