শেরপুরে শিশুশ্রম বন্ধ, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নয়ন, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা বাড়ানো সহ শিশু অধিকার সুরক্ষার দাবী জানিয়েছে ন্যাশনাল চিলড্রেনস টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ) শেরপুর জেলা কমিটি। শিশু অদিকার সপ্তাহ উপলক্ষে ১১ অক্টোবর সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক মতিবিনিময় সভায় এনসিটিএফ সদস্যরা তাদের জেলার শিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও শিশু জরিপের তথ্য তুলে ধরে এসব দাবী জানায়।
এনসিটিএফ জেলা কমিটির চাইল্ড পার্লামেন্ট মেম্বর শীর্ষ সরকারের সভপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করে চাইল্ড রিসার্চার মুশফিকুর রহমান রিদম। অনুষ্ঠানের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ প্রধান অতিথি এবং স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক এটিএম জিয়াউল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোক্তাদিরুল আহমেদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল ইসলাম, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আসলাম খান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অতিথিরা শিশুদের বক্তব্য মনোযোগের সাথে শুনেন এবং শিশু অধিকার সুরক্ষা, এসডিজির আলোকে সরকারের গৃহিত নীতি-কৌশল ও পরিকল্পনা সম্পর্কে শিশুদের অবহিত করে। তারা তাদের পক্ষ থেকে সমস্যাগুলোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও আশ্বাস দেন।
চাইল্ড রিসার্চার তাসনুভা আলম জরিপের তথ্য তুলে ধরে জানান, করোনাকালে বাল্যবিয়ের হার বেড়ে গেছে। বেড়েছে শিশু শ্রমের হারও। ১০৮ জন শিশুর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, একজন শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে পরিবারের সহায়তার জন্য তার বাবার সাথে কাজে যোগ দিয়েছে। দরিদ্র পরিবারের ওই শিশুকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনার জন্য তার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করার দাবী জানানো হয়। একইসাথে সে বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের বাজেটে শিশুদের মতামত গ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির দাবী জানায়।
এনসিটিএফ সভাপতি আফিফ আল আবরার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে স্কুলে স্কুলে ক্যাম্পেইন পরিচালনা জোরদার ও প্রশাসনের নেতৃত্বে ফেসবুক গ্রুপ খোলে তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা চালুর কথা তুলে ধরে। আদিবাসী এলাকাগুলোতে শিশু অধিকারের বার্তা এবং বয়:সন্ধিকালীন সময়কালে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে সেসব এলাকায় সচেতনতামুলক সভা করার কথাও জানায়। চাইল্ড পার্লামেন্ট মেম্বার মুহসানাত তাহিরাহ শেরপুর জেলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেডের স্বল্পতা ও লিফট বিকল থাকার কথা তুলে ধরে সমস্যা সমাধানের দাবী জানায়। শিশু ওয়ার্ডে বেড মাত্র ৩২টি। কিন্তু সেখানে গাদাগাদি করে, মেঝেতে-বারান্দায়ও অনেক শিশুকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তাছাড়া ২টি লিফটের একটি বিকল থাকায় রোগী ও তার স্বজনদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সহ-সভাপতি তাবাসসুম রহমান নাবিয়া জেলা শিশু পরিবারের বসবাসকারি এতিম শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা দাবী জানানয়। সেইসাথে ১৮ বছরের পর সেখানে বসবাসকারি শিশুদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও দাবী জানায়। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর ইফাত বলেন. জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে কিংবা তথ্য সংশোধনে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থও গুনতে হচ্ছে। এ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা দরকার। সাংগঠনিক সম্পাদক ফাউজিয়া আবিদা ও কার্যকরি সদস্য তাসফিয়া তারান্নুম তিফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থা উন্নত করার দাবী জানায়। তারা বলেন, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাথরুম থাকলেও সেগুলো অপরিচ্ছন্ন থাকে। তারা জেলার যেকোন একটি বিদ্যালয়ে স্যানিটারি প্যাড সহ হাইজিন কর্ণার স্থাপনের দাবী জানিয়ে বলেন, যেখান থেকে বয়:সন্ধিকালীন মেয়েরা তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে নিতে পারবে। শিশু সাংবাদিক রাইসুল ইসলাম ভার্চূয়াল মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষায় সাইবার বুলিং প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবী জানায়। স্বেচ্ছাসেবক রজত সাহা অন্তু ইভটিজিং ও কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনের এলাকাগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার দাবী জানান। সেইসাথে শহরের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে ডাস্টবিনগুলো অপসারণ করে অন্যত্র স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ দাবী করেন। অনুষ্ঠানে জনউদ্যোগ আহ্বায়ক শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ও সাংবদিক হাকিম বাবুল শিশুদের উন্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করেন।
জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। শিশুদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠতে হবে। এজন্য সবাইকে তিনি লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হবার আহ্বান জানান। সেইসাথে সরকার শিশুদের উন্নয়নে অধিক মনোযোগ দিয়েছে উল্লেখ করে শিশু অধিকার সুরক্ষায় বিভিন্ন নীতি-কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা জানান। শেরপুর জেলার শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও উন্নয়নে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
বিশেষ অতিথি স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক এটিএম জিয়াউল ইসলাম বলেন, আমাদের মাঝে সিমপ্যাথি’র (সহানুভুতি) সাথে সাথে ইমপ্যাথি (সমানুভুতি) থাকতে হবে। অনেক কিছুই এখানে তুলে ধরার হয়েছে, এজন্য তিনি এনসিটিএফ শিশুদেরকে ধন্যবাদ জানান। তবে শিশুমৃত্যুরোধে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেবল সাঁতার না জানার কারণে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এসব বিষয় তুলে আনতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজীদের বালাম বই ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার কথা তুলে ধরেন। এজন্য সরকারি নীতিতে আরও পরিবর্তন আনতে হবে বলে তিনি অভিমত দেন।
মতবিনিময় সভার শেষে শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ^ গড়ি’ শ্লোগানে এনসিটিএফ জেলা কমিটি আয়োজিত চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার বিজয়ী শিশুদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করা হয়।