দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নে ট্রে পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের প্রতি কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে ধান চাষে সফলতা পাচ্ছে শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার বেশ কিছু কৃষক।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যেভাবে ফসলি জমি কমতে শুরু করেছে, এমতাবস্থায় ট্রে পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সময়োপযোগী। সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারে ট্রেতে চারা উৎপাদনের ফলে ধানের উৎপাদন খরচ কমানো, শ্রমিক সংকট নিরসন ও সময় সাশ্রয় সম্ভব।
বানেশ্বরদী গ্রামের কৃষক মো. শামছুজ্জামান জুয়েল জানান, তিনি ৬৪ টি ট্রেতে ধানের বীজ বপন করেছিলেন। তা দিয়ে ৭০ শতাংশ জমি রোপন করা হয়। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ১৫ থেকে ২০ দিন বয়সের চারা মাঠে রোপন কার যায়।
অনেক কৃষক জানান, ট্রে’র ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ রাসায়নিক ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি সার মিশ্রিত দো-আঁশ মাটি নিয়ে এর ওপর চারা রোপনের পর তা ১৩ থেকে ১৫ দিন পর মাদুরের মতো করে তোলা হয়। এরপর রোপন যন্ত্র রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মাধ্যমে মাঠে রোপন করা হয়। এ পদ্ধতিতে একজন শ্রমিক একটি মেশিন দিয়ে দিনে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ধানের চারা রোপন করতে পারেন। ট্রে পদ্ধতিতে চারা টেনে তুলতে হয় না, তাই চারার শিকড় ছিড়ে না। ফলে শিকড় দ্রুত মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এবং গাছ সবল হয়ে বেড়ে ওঠে।
উপসহকারী কৃষি অফিসার আশরাফুল ইসলাম ও সারোয়ার জাহান শাওন জানান, অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অনেকে। এই পদ্ধতিতে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ধান চাষে ফলন বাড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এ পদ্ধতি জনপ্রিয় করা গেলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি চাল রপ্তানির ক্ষেত্রেও দারুণ অগ্রগতি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কৃষিবিদ শেখ ফজলুল হক মনি জানান, সনাতন পদ্ধতিতে চারা রোপন করলে ৩৫ থেকে ৪৫ দিনের চারা রোপন করতে হয়। সনাতন পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি না করে প্লাস্টিকের ফ্রেম বা ট্রেতে বীজ বপন করতে ৩:২ অনুপাতে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ দিয়ে বীজতলা তৈরি করা হয়। এরপর বীজ ছিটিয়ে পুনরায় অর্ধেক মাটি ও গোবর মিশ্রণ দিয়ে সমতল জায়গায় রেখে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। বীজতলা তৈরির ৩ দিনের মধ্যে অঙ্কুর বের হয়ে যায়। ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা উৎপাদন করে রোপণ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে কৃষক ভালো মানের চারা উৎপাদন করে অল্প সময়ের মধ্যে অধিক জমিতে ফসল ফলাতে পারেন।
অন্য এক কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কৃষিবিদ মাহমুদুল হাসান মুসা জানান, এই পদ্ধতির অন্যতম সুবিধা হলো ট্রেতে করে চারা উৎপাদন করতে জায়গা কম লাগে। সনাতন পদ্ধতির বীজতলার চেয়ে ট্রে পদ্ধতিতে চার উৎপাদন করলে প্রায় চারগুণ কম জায়গা লাগে। ঝড়-বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক যে কোনো দুর্যোগে নিরাপদ স্থানে উঠিয়ে রাখা যায়। খরচ কম হয় বলে এ প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষিশ্রমিকের সংকট নিরসন এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বীজতলার জায়গা, শ্রম ও সময় কম লাগে; ঝুঁকিও নেই এমনকি মৌসুমী শ্রমিকের অভাবে চাষাবাদ বাধাগ্রস্ত হতে হয়না।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ট্রেতে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে সমলয়ে চাষাবাদের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারসহ ধানের উৎপাদন খরচ কমানো, শ্রমিক সংকট নিরসন ও সময় সাশ্রয় সম্ভব। তিনি আরও জানান, সফলভাবে ফসল উৎপাদনের জন্য সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় কৃষককে বীজ সার ও ফসলের উপকরণ পাচ্ছেন। এই পদ্ধতিতে ধানের আবাদে কৃষকের আগ্রহ আরও বেড়ে যাবে বলে, আশা করেন তিনি। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষক স্বল্প সময়ে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারবে বলছেন কৃষি কর্মকর্তারা। এই পদ্ধতিতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষক স্বল্প সময়ে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারবে বলে দাবি এ কৃষি কর্মকর্তার। তিনি বলেন, বিশ্বাসীকৃত অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান চাষে মাঠ প্রদর্শনী করা হচ্ছে। ফলন বাড়ায় কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের তরুণ-যুবক কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভবিষতে আমাদের যান্ত্রিকতার দিকেই যেতে হবে। কৃষকদের কাছে ট্রে পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন আরও জনপ্রিয় করা গেলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি চাল রপ্তানি করতে সক্ষম হবে। এজন্য সরকার ও কৃষকদের সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন বলে উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান।