শেরপুর জেলার নকলা উপজেলায় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রায় শতভাগ শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও, নির্মাণ করা হয়নি মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার নকলা উপজেলায় ১১৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিও ভুক্ত ৩০টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০ টি সংযুক্ত মাদ্রাসা ও ৩টি কলেজ রয়েছে।
প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা অফিসার পার্থ পাল জানান, উপজেলায় ১১৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও ৭১ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৪ টি কেজি স্কুল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রাম উন্নয়ন কর্ম কর্তৃক পরিচালিত ৬টি, জার্মানের অর্থায়নে পরিচালিত মাটি সংগঠনের ৫টি, কারিতাস পরিচালিত ৪টি, ব্র্যাক পরিচালিত ৩টি বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর কোনটিতেই শহীদ মিনার নেই।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফজিলাতুন নেছা জানান, গত বছর (২০২০ সাল) উপজেলার এ ১১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭টিতে শহীদ মিনার ছিলো, আর প্রক্রিয়াধীন ছিলো ৬টিতে। ফলে পাশ্ববর্তী কোন এলাকার শহীদ মিনারে বা কাঠ, কাগজ বা কলাগাছ দিয়ে নির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হতো। কিন্তু এবছর উপজেলার ১১৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। স্থায়ীভাবে নির্মিত এসকল শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোসহ যে কোন জাতীয় দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন শিশু শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ঠ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এমন সূবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে উপজেলা শিক্ষা অফিস। এডিবির ক্ষুদ্র মেরামত ও সামাজিক সহযোগিতার অর্থায়নে প্রতিষ্ঠান গুলোতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এসকল শহীদ মিনার। বাকি ৩টি বিদ্যালয়ে নদী ভাঙন ও জায়গার সমস্যা থাকায় নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি থাকা ওই ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে এ শিক্ষা অফিসার জানান। তিনি আরও জানান, প্রত্যেকটি শহীদ মিনারের প্রাকল্পিক নির্মাণ ব্যয় করা হয়েছে ৯০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনার বড় ও সুন্দর করার স্বার্থে এলাকাবাসীরা আর্থিক সহায়তা করায় ওইসকল শহীদ মিনারের নির্মাণ ব্যয় বেশি করা হয়েছে বলে এলাকাবসী সূত্রে জানা গেছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ জানান, উপজেলায় ৩০টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০টি সংযুক্ত মাদ্রাসা ও ৩টি কলেজ থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। ১০ কি ১২ টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার আছে; আর প্রক্রিয়াধীন আছে ৩-৪ টিতে। তাছাড়া ২০টি সংযুক্ত মাদ্রাসার মধ্যে শুধুমাত্র বানেশ্বরদী ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা ও কলাপাড়া মেফতাহুল উলুম দাখিল মাদরাসা প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলায় কলেজ রয়েছে ৩ টি, আর এ ৩টি কলেজেই শহীদ মিনার রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ আরও জানান, মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে সরকারি ভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের কোন প্রকার উদ্যোগ ও অর্থায়ন না করায় এখন পর্যন্ত বিদ্যালয় ও মাদরাসা গুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষালয় চত্বরে শহীদ মিনার নির্মাণ হওয়ায় এখন থেকে স্কুল ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জাতীয় দিবসগুলোর তাৎপর্য ও শহীদদের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। তাছাড়া মায়ের ভাষা ও দেশ স্বাধীন হওয়া সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে বিদ্যালয় ও মাদরাসা পরিচালনা পরিষদ, এলাকাবাসী ও শিক্ষকদের বরাবর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। তবে আগামীতে সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা না পেলেও বাকি স্কুল ও মাদরাসা গুলোতে শহীদ মিনার নির্মানে স্থানীয় ভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে শহীদ বেদী নির্মান করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ আরও বলেন, নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতায় উদ্বুদ্ধ করতে শহীদ মিনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গভীর শ্রদ্ধাভরে যদি দিবসটি পালন করা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা দেশের স্বাধীনতার চেতনার মুল্যবোধে জাগ্রত হবে। তাই যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে আসছি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তথা ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি পালন করে আসছে।
কর্মসূচির মধ্যে প্রভাতফেরি, র্যালি, আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করা অন্যতম। কিন্তু জেলার নকলা উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না থাকায় স্বাভাবিক কারনেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে হাতেগুণা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার ঘোষিত এই কর্মসূচি যতাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। নিজ প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার না থাকায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারেন না। তাই অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ দিবসটিতে অন্য প্রতিষ্ঠানে পুষ্পস্তবক অর্পণের অজুহাতে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কৌশলে ছুটি ভোগ করেন, যা আমাদের জতীয় জীবনে কলঙ্কের সামিল! কারন যেখানে আমাদের ভাষার স্মরণে যে দিবসটি সারা বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়, সেখানে এ ঐতিহাসিক দিবস পালনে আমরা নানান অজুহাতে পার পেয়ে যাই।
ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর অতিবাহিত হতে চলছে। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রায় সবাই পরপারে চলেগেছেন। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে হলে বই পড়া এবং শহীদ মিনার সম্পর্কে জানা আবশ্যক হয়ে পড়েছে; অথচ দেশে শতকরা গড়ে ৩০ ভাগ থেকে ৩৫ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। গ্রামে এই হার কম বেশি ৭ ভাগ থেকে ১২ ভাগ।
দেশে নতুন একটি জেলা নিয়ে ছোট-বড় ৬৫টি জেলা রয়েছে। যদি এই ৬৫টি জেলাকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় এনে পর্যায়ক্রমে প্রতিবছর একটি করে জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরী করার উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পর হলেও আজ সব কয়টি জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শেষ হতো। শহীদ মিনার না থাকায় শিক্ষার্থীরা মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও আন্তার্জাতিক মাতৃভাষার তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহি হচ্ছে না, এমনকি সঙ্গত কারনে সঠিক ধারণা নিতে পারছেনা। ফলে মাতৃভাষার ইতিহাস জানতে বর্তমান প্রজন্মকে বেগ পেতে হচ্ছে বা অনেকেই জানতে পারছেন না বলে মনে করছেন অনেকে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও আন্তার্জাতিক মাতৃভাষার তাৎপর্য সম্পর্কে কতটুকু জানতে পারবে তা ভবিষ্যৎ বলে দিবে।