দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক পাওয়ার পর শেরপুর জেলার নকলা পৌর সভার নির্বাচনকে সামনে রেখে সরব মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। পৌর এলাকায় প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে আটশাট বেধে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হাফিজুর রহমান লিটন এবং বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত ধানের শীষ প্রতীক পাওয়া মো. এনামুল হক রিপন।
এ নির্বাচনে দলীয় মনোনিত নৌকা বা ধানের শীষের প্রার্থীদের জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক মেয়র অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান (নারিকেল গাছ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন আনার (জগ)। তাঁরা সকলেই বিভিন্ন যৌক্তিক কারনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তাই স্বাভাবিক কারনেই নকলা পৌরসভার কে হবেন নতুন পৌর মেয়র, এনিয়ে চলছে নানান কল্পনা জল্পনা, চলছে এলাকা ভিত্তিক ভোটের হিসাব নিকাশ। প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কাছে দোয়া ও ভোট চাইছেন, দিচ্ছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি। অনেক ভোটাররাও প্রার্থীদেরকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভোটারদের এমন প্রতিশ্রুতি পেয়ে সকল প্রার্থীই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
নকলা উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, এবার নকলা পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে ৫ জন, সংরক্ষিত মহিলা কমিশনার পদে ১৫ জন ও সাধারন কমিশনার পদে ৩৯ জন মনোনয়নপত্র উত্তোলন করেন এবং মনোনয়নপত্র জমা করার শেষ দিনে তাঁরা সকলেই নিজ নিজ সমর্থকদের সাথে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা করেছিলেন। তবে বাছাইয়ে যথাযথ কাগজপত্র নাথাকায় মো. মুক্তার হোসেন নামে এক মেয়র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল বলে গন্য হয়। ফলে মেয়র পদে ৪ জন, সংরক্ষিত মহিলা কমিশনার পদে ১৫ জন ও সাধারন কমিশনার পদে ৩৯ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন।
নকলা পৌরসভায় মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ১৬০ জন, এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১৩ হাজার ৮ জন ও নারী ভোটার ১৪ হাজার ১৫২ জন। ৯টি ওয়ার্ডের ভোটারদের সুবিধার্থে ১২টি কেন্দ্রের ৮১টি ভোটকক্ষের মাধ্যমে ভোটগ্রহন করা হবে। আসন্ন পৌরসভার নির্বাচন অবাদ ও সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে নির্বাচনী কাজ পুরোদমে শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারি রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন অফিসার তারেক আজিজ।
নকলা পৌরসভার কে হতে পারেন নতুন মেয়র? এমন প্রশ্ন নিয়ে কয়েকজন নারী-পুরুষ ভোটারের সাথে আলাপ হলে, ভোটার আলমগীর হোসেন, আকমল মিয়া, ইসরাফিল হোসেন, তারামন বিবি, আব্দুল হাই ও শেফালী বেগমসহ অনেকে বলেন, যে প্রার্থী নকলা পৌর এলাকায় উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন বলে মনে হবে আমরা তাকেই ভোট দিয়ে জয়ী করবো। এদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য প্রতীকে ভোট দিয়ে জয়ী করলে পৌর এলাকার উন্নয়ন স্বাভাবিক কারনেই কম হবে। তাই এ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে আগামী মেয়াদের মেয়র নির্বাচিত করবেন বলে তারা জানান। তারা বলেন- আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নৌকা প্রতীক ছাড়া বিএনপি বা বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর অন্য প্রতীকের প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে, পৌর এলাকার উন্নয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের মতো উন্নয়ন বরাদ্দ পাবেন না। ফলে তেমন কোন কাজ করতে পারবে না, তাই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছাড়া অন্যকোন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে লাভ নেই। ভোট দিতে হবে সকলের উন্নয়নের স্বার্থে, এমনটাই জানানদেন সুশীলজনসহ অনেকে।
মেয়র পদে আওয়ামী লীগের দলীয় (নৌকা প্রতীকে) মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান মেয়র মো. হাফিজুর রহমান লিটন বলেন, আমি চলতি মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে সাবেক কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি’র সার্বিক পরামর্শমূলক নির্দেশনায় উন্নয়ন মূলক কাজের শুরুতেই নকলা পৌরসভাকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। তাছাড়া আমার মেয়র আমলে পৌর এলাকার যে উন্নয়ন হয়েছে, তা নকলা পৌরসভা গঠন হওয়ার পর থেকে আমার পূর্ব পর্যন্ত তা কোন মেয়রের পক্ষেই করা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, তাঁর আমলে সারা পৌর এলাকায় সড়ক বাতির ব্যবস্থা করাসহ অপরাধ ঠেকাতে শহরে সড়কে সৌর বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া রাস্তা ও কালভার্ট নির্মান ও সংস্কার, পরিবেশ রক্ষায় পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যাত্রী ছাউনি, পৌরবাসীদের মাঝে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন সংযোগ, খেলার মাঠ (শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম), শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা বিবেচনায় নকলা শহর থেকে গরুর হাট নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা ও বৃক্ষ রোপন করা, বাল্যবিবাহ, মাদক, ইভটিজিং-এর মতো বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে বিভন্ন কর্মসূচি পালন করাসহ অগণিত দৃশ্যমান উন্নয়ন মূলক কাজ করেছেন বলে তিনি দাবী করেন। এছাড়া শিশুসহ সব পেশা-শ্রেণীর মানুষের স্বাস্থ্য ও মানসিক উন্নয়নে মিনি শিশুপার্ক করার পরিকল্পনা, কুর্শাবাদাগৈড় এলাকা থেকে পেকুয়া বিল পর্যন্ত (পৌর সীমা পর্যন্ত) সূবর্ণখালি বিলের তীরে পার্কের আদলে পাড় রক্ষা বাধ নির্মানের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। যা অনেকটুকু এগিয়ে রয়েছে। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের অংশ হিসেবে নকলা পৌরবাসীরা নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে অসমাপ্ত কাজ গুলো সমাপ্ত করার সুযোগ দিবেন বলে বর্তমান মেয়র হাফিজুর রহমান লিটনের দৃঢ় বিশ্বাস।
বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত ধানের শীষ প্রতীক পাওয়া তরুণ সমাজ সেবক মো. এনামুল হক রিপন জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, নকলা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী ছাড়াও আওয়ামী লীগের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন, রয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক প্রার্থীও। এতে স্বাভাবিক কারনেই আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে, ফলে আওয়ামী লীগের এ ৩ জনের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হবে এতে কারও কোন প্রকার সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু নকলায় বিএনপি-তে কোন বিবেধ-দ্বিমত না থাকায় আমি একক প্রার্থী হিসেবে এ পৌর সভার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। বর্তমান কালের ভোটাররা তাদের মহামূল্যমান ভোট খানা ভেবে চিন্তেই প্রদান করবেন তিনি মনে করছেন। কোন ভোটার তাদের ভোট নষ্ট করতে আগ্রহী নয়। সবাই চাইবেন তারা যাকে ভোট দিবেন সেই প্রার্থী যেন নির্বাচিত হন। এ বিবেচনায় বিএনপি’র সকল ভোটারসহ অন্যান্য সাধারণ ভোটারতো বটেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থক ভোটাররাও ধানের শীষে ভোট দিয়ে তাকে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করবেন বলে তিনি আশা করছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক মেয়র অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমি নকলা পৌরবাসীকে মেয়র হিসেবে দীর্ঘদিন সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন ইচ্ছা করলে আমি শত কোটি টাকার মালিক হতে পারতাম। আজ আমাকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে বর্তমানের এই পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে হতো না। অন্যান্যদের মতো জমানো টাকা দিয়ে আমিও এ পৌর নির্বাচন করতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, ভেবেছিলাম জনগনের স্বার্থে নৌকা প্রতীক নিয়ে আমি পৌরসভার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবো। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে আমাকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। কিন্তু জনগনের চাওয়া পূরণে তথা সাধারন ভোটারদের চাপের মুখে আমাকে এ নির্বাচনে আসতে হয়েছে। যেহেতু জনগন আমাকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করেছেন, সেহেতু তারাই তাদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে নারিকেল গাছে ভোট দিয়ে তাকে দ্বিতীয় বারের মতো পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত করবেন বলে সাবেক মেয়র অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান শতভাগ আশাবাদী।
অন্য এক স্বতন্ত্র প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন আনার বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনিত ও বিদ্রোহী মিলে দুই জন প্রার্থী নির্বাচনে রয়েছেন। অন্যদিকে নকলাতে বিএনপির দলীয় কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়, ফলে বিএনপির ভোটারদের মধ্যেও নির্বাচনী কোন আমেজ নেই বললেই চলে। এসব বিবেচনায় ভোটাররা আওয়ামী লীগ সরকারের আমল বিবেচনা করে দলীয় বিভেদকে দূরে ঠেলে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে আমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যোগ্য মনেকরে জগ মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন। তাছাড়া পৌরসভার বিশাল একটি অংশের মধ্যে আমি একক প্রার্থী হওয়ায় পৌর সভার অন্যান্য এলাকার ভোটাররাও এবিষয়টি বিবেচনায় আনবেন বলে তাঁর বিশ্বাস।
উল্লেখ্য, তৃতীয় দফায় দেশের ৬৪ টি পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ছিলো গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার, মনোনয়নপত্র বাছাই করে প্রার্থীদের বৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি রবিবার, প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিলো ১০ জানুয়ারি রবিবার, ১১ জানুয়ারি সোমবার প্রার্থীদের মাঝ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে বর্তমান মেয়র মো. হাফিজুর রহমান লিটন পেয়েছেন নৌকা প্রতীক, মো. এনামুল হক রিপন পেয়েছেন ধানের শীষ প্রতীক, সাবেক মেয়র অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান পেয়েছেন নারিকেল গাছ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন আনার পেয়েছেন জগ প্রতীক। আগামী ৩০ জানুয়ারি শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহন করা হবে।