মো. মোশারফ হোসাইন
বঙ্গবন্ধু শব্দটি আমরা শুধুই শুনিনি টিভিতে, মিছিলে, দেওয়াল পোস্টারে, খবরের কাগজে ছবির সাথে এ শব্দটি ছাপা হয় যা, সারা বিশ্ববাসী দেখে; কাজেই শব্দটি কারও অজানা থাকার কথা নয়। আসলে এটি একটি জাতীয় উপাধি। এদেশের মানুষ ভালোবেসে একজন রাজনৈতিক মহান নেতাকে এই উপাধিটি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তাঁর স্মৃতি, তাঁর অবদান, তাঁর সফলতা তাঁকে অমর করে রেখেছে। এ জন্যই এদেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তাঁর সম্পর্কে শুনতে ও জানতে চায়। পৃথিবীতে অনেক ধনী, জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হতে দেখা যায়। সে তুলনায় রাজনৈতিক নেতাদের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী তেমন একটা পালিত হয় না, যদিও রাজনীতি সাহিত্যের চাইতে কোন অংশে কম নয়। আর তাইতো ১৭ মার্চ ও ১৫ আগষ্ট এ দুটি তারিখে বাঙালি জাতি যথাযথ মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও মৃত্যুদিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।
এতক্ষণ যাকে বঙ্গবন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে আসছিলাম তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আর তাঁর ডাক নাম খোকা (খোকন)। সাবেক ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে টুঙ্গিপাড়ার এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ১৭ মার্চ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। শেখ লুৎফুর রহমান ও সাহেরা খাতুনের ছেলে মেয়েদের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য় সন্তান এবং ছেলেদের মধ্যে ছিলেন বড়। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান আদালতের সেরেস্তাদার থাকলেও তাঁর ইচ্ছা ছিল খোকন আইনজীবী হয়ে দেশ ও জাতির মুক্তির দাবীতে বিভিন্ন আন্দোল সংগ্রামে যোগ দিবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতার গুণেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু পিতা-মাতার আদর বেশি পেয়েছিলেন এবং প্রতিভা বেশি নিয়ে জন্ম নেওয়ায় তিনি বেশ জেদী স্বভাবের ছিলেন, বেশ চঞ্চল ও একগুঁয়ে ছিলেন তিনি। প্রকৃতিতে এমন মানুষই বড় হয়ে সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, রাজনীতিতে, সাংবাদিকতায় নতুন নতুন পথ ও মত সৃষ্টি করেন। তাই হয়ত গীমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়া লেখার চাইতে সামাজিক কাজে তার আগ্রহ বেশি ছিল। বাবার আইনজীবী বানানোর আশা ক্রমশই নিরাশ হতে থাকে। তাঁকে প্রাইমারী স্কুল থেকে এনে মাদারিপুর ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করালেন। সেখানেও আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়ায় নিজের কর্মস্থল গোপালগঞ্জের মিশন হাইস্কুলে নিয়ে ভর্তি করেন। একের পর এক স্থান পরিবর্তন করায় ১৯৩৪ সালে শেখ মুজিব মাত্র ৫ম শ্রেণির ছাত্র। সেখানে বাবার শাসনে পড়া লেখা ভালো ভাবে করলেও হঠাৎ করেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। তবে এ আগ্রহের সাথে জড়িয়ে ছিল রাজনীতি।
শুরু হলো স্বদেশী আন্দোলন। এ আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গায়ে। তৎকালে পুলিশের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে একদল তরুনের সাথে তিনিও ঢিল ছুড়লেন থানায়। যথা সময়ে তাঁর পিতার কাছে এ সংবাদ আসলেও পরাধীনতার আগুনে পুড়া লুৎফুর রহমান মনে মনে রাগের বদলী বরং খুশিই হন। শরীরের প্রতি অযত্ন অবহেলায় শেখ মুজিব ৭ম শ্রেণিতে থাকাবস্থায় চক্ষু রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসায় ভালো হতে সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। এ ৩টি বছর লেখা পড়া সহ সকল কাজকর্মে নিজেকে জড়াতে ব্যর্থ হন তিনি। ১৯৩৯ সালে পুনরায় মিশন স্কুলে ভর্তি হলে, সে সময় স্কুল পরিদর্শনে আসা বাংলার বাঘ নামে খ্যাত শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে আইন শৃঙ্খলা বিরোধী আচরণের জন্য বন্ধুদের সাথে খোকনকেও ৭দিন হাজত বাস করতে হয়। এ পর থেকেই তিনি রাজনীতিকে মূল কাজ হিসেবে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং খোঁজা শুরু করলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু। ঠিক এ সময়েই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়ে যান সেই ডানপিটে স্বাধীনচেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দীর দেয়া উৎসাহ উদ্দীপনায় তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়া লেখায় পুণরায় মনোনিবেস করেন। ১৯৪২ সালে মিশন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওই সালেই পড়া লেখার উদ্দেশ্যে কলকাতায় পাড়ি জমান তিনি। যদিও তিনি ছাত্র জীবনেই আত্মীয়া ফজিলাতুন্নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন। মা, বাবা, স্ত্রী ছেড়ে তিনি কলকাতা গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে থাকতেন তার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী তখন মুসলিমলীগের বড় মাপের একজন নেতা। এ সুবাদে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিমলীগে যোগদান করেন। পাশাপাশি হলওয়েল মনোমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলনের সুবাদে নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সাথে পরিচয় হয় বঙ্গবন্ধুর। ইসলামিয়া কলেজে বি.এ শ্রেণিতে থাকাবস্থায় কোলকাতার ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীনতা লাভের সময় তিনি বি.এ পাস করেন। ১৯৫০ সালে এক ভুখা মিছিলে মাওলানা ভাসানী ও সামছুল হকসহ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন- উর্দূ এবং উর্দূই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এ ঘষোণার শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধও গড়ে উঠে। সারা বাংলাদেশ ব্যাপী। এ ঘটনায় সারাদেশে হরতাল ডাকা হয়। নূরুল আমীন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। তবুও ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন। মিছিলের উপর পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে মেধাবী ছাত্র রফিক, সফিক, বরকত, ছালাম, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকেই শহীদ হন। এভাবেই জন্ম নেয় অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারিতেই শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান এবং আওয়ামী লীগের সম্পাদক নিযুক্ত হন। তার পর পরই আন্দোলনের চাপে মুসলিমলীগ ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ঠিক এমুহুর্তে যুক্তফ্রন্ট নামে নতুন দলের আত্ম প্রকাশ ঘটে। নৌকা প্রতীক নিয়ে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয় এবং শেখ মুজিব আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা, ১১ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন ভাবে জেগে উঠে বাঙালি জাতি। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালিন ছাত্র নেতা তোফায়েল আহম্মেদ কর্তৃক তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করে। এ অবস্থায় জাতির পিতা বুঝতে পারলেন স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাঙালি জাতির উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার অবসান হবে না। তাই তিনি ১৯৭১ সালের ৭মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এ ডাকেই শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ নিরীহ ঘুমন্ত বাঙ্গালীর উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। হানাদাররা ওই ২৬মার্চ রাতেই জাতির পিতাকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। শুরু হয় আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ। এদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজ উদ্দিন আহমদকে প্রধান মন্ত্রী করে ৯ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এ সরকার ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় (বর্তমান নাম মুজিব নগর)-এ দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শপথ নেয়। মুক্তিযুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। জাতীয় চার নেতা, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হানীর বিনিময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর -আলশামস বাহিনীকে পরাজিত করে দীর্ঘ নয় মাস রক্ত ক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বিজয় ছিনিয়ে আনেন। জাতি পায় নিজস্ব সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও রচিত জাতীয় সংগীত, বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বিশ্বের ইতিহাসে যোগ হয় আরেকটি স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপ থেকে টেনে তুলে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত। ঠিক তখন স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করার পর দক্ষিন এশিয়ার এই অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অস্তিত্বকেই প্রায় বিপন্ন করে তুলেছিল। এই নতুন রাষ্ট্রের চার রাষ্ট্রনীতি- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে ক্ষত-বিক্ষত করে একে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি ধাঁচের রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায় রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী ও তাদের দোসর সামরিক খুনি চক্র। ফলে এ অঞ্চলের শান্তি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং স্থিতিশীলতার পরিবর্তে দেখা দেয় সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পালাক্রমিক সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রায় আঠারটি ব্যর্থ খেলা। ঘাতকরা হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। মার্শাল’ল জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। অবৈধ সরকার গঠন করে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন দুতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। স্বাধীনতা বিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের এ দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অংশীদার করে। দেশ যখন এরকম একটি জটিল-কুটিল চক্রান্ত-প্রতিচক্রান্তের আবর্তে নিয়োজিত, ঠিক তখনি ১৯৭৫ সালে বিদেশে (জার্মান) থাকায় ঘটনাক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এক সপ্তাহ আগে ১১ মে ‘নিউজ উইক’এ এক সাক্ষাতকারে নির্ভীক শেখ হাসিনা বলেন- জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত থেকে বঞ্চিত হয়’। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারী তরুনী এ নেত্রী বলেন- যেসব কাজ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে আমি বিবেচনা করি তার মধ্যে থাকবে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের পূর্ণগণতান্ত্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তিনি আরও বলেন ‘১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করে দলের নেতাকর্মীরা আমার মহান পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমি বাবার অসাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার প্রত্যয় নিয়েই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করব, ইনশাল্লাহ।’ তিনি যেদিন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন এ দেশ রত্নকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ১৭ মে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে বিমান বন্দরে উপস্থিত হন। সেদিন লাখ লাখ মানুষের হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসায় সিক্ত হন শেখ হাসিনা। তিনি দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ৯০’এর গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (নৌকা প্রতীক) বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। তিনি দেশের গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, দারিদ্র দূরীকরণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকালের অমীমাংসিত গঙ্গার পানি চুক্তির স্বাক্ষর তাঁর ঐতিহাসিক সাফল্য। ১৯৯৬ সালে তাঁর আমলেই কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ প্রথম বারেরমত খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২৩ জুন উত্তর বাংলার সঙ্গে পূর্ব বাংলার যোগাযোগে শত বছরের অবহেলার অবসান ঘটিয়ে তিনি উদ্বোধন করেন যমুনা নদীর উপর নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু)। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করে ওই অঞ্চল এবং গোটা দেশে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেন, যা গোটা বিশ্বকে অভিভূত করে। এ পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রতিষ্ঠার সাফল্যের জন্যে ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনাকে ইউনেস্কোর শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ৩১তম অধিবেশনে তারই উদ্যোগে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ শাসন আমলে এ ধরনের আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ‘ডটার অব ডেমোক্রেসি’ হিসেবে বিশ্ব ব্যাপী পরিচিতি, উন্নয়ন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, যোগাযোগ ও যাতায়তের অবকাঠামো নির্মাণে সাফল্য, হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন, কৃষি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও মর্যাদাবৃদ্ধি, নারী উন্নয়নে সফলতার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন, ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ফেলিক্স হুফে বয়েনি শান্তি পুরস্কার’ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘সেরেস পদক’ নরওয়ের মহাত্মাগান্ধী ফাউন্ডেশনের ‘গান্ধী পদক’, দারিদ্র বিমোচনে শেখ হাসিনার সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ইতালিতে অনুষ্ঠিত জি-৮ সম্মেলনে তাঁকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে এক বিরল সংবর্ধনা প্রদান করে, যা মতার বাইরে থাকা এশিয়া মহাদেশের কোন নেতাকে এভাবে আমন্ত্রণ জানানোর নজির এটাই প্রথম। নারীর মতায়ন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিশাল সাফল্য বিশ্ব ব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এরপর রাজনৈতিক ও আইনী জটিলতা দরুন দেশে নেমে আসে নৈরাজ্য। পুনরায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে এবং জনগণের কল্যাণে নানামূখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। ২০০৯ সাল থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ববার গ্রহণ করার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দিন বদলের অঙ্গীকার, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র বিমোচন (৪০%-২৬%), কৃষি, নারীর ক্ষমতায়ন, জ্বালানী, গ্রামীণ অবকাঠামো, বৈদেশিক কর্মসংস্থানসহ নানা কর্মসূচী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা ও এমডিজির লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে জাতিসংঘের সাউথ সাউথ পুরস্কার লাভ, এক কোটির উপরে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রায় বাংলাদেশের আয়তনের সমপরিমাণ সমুদ্র সীমায় সার্বভৌমত্ব অর্জন, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রতি বছর জানুয়ারীতে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ (যা বিশ্ব দরবারে মডেল), শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, শিশু মাতৃ মৃত্যুর হার কমানো, ঢাকা-চট্টগ্রামে অসংখ্য উড়াল সেতু নির্মাণ, পাটের ও ছত্রাকের জন্ম রহস্য আবিস্কার, পাতাল রেল পথ নির্মাণের মহা পরিকল্পনা, ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় করণ, পর্যায় ক্রমে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সরকারি করণ এবং বিশ্ব মন্দা সত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে বিশ্ব সভায় এক নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। তিনি তাঁর আদর্শ, পরিকল্পনা ও জীবনবোধের আলোকে বহু ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংস্কার সাধক এবং প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সাধন করে বাংলাদেশকে বিশ্বে দিয়েছেন নতুন ভাবমূর্তি এবং গৌরবজ্জল পরিচিতি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জোট সরকার পুনরায় (তৃতীয়বার) ক্ষমতায় এসে দেশ পরিচালনা করছেন। সবমিথ্যার বেসাতিকে নিধন করে সত্য ও সততার আলোকে দেশজ সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নকে নিশ্চিত করার সকল শিক্ষাই উপস্থাপন করছেন। ২০১৭ বিজয় দিবস উদযাপনের আগেই বাংলার ইতিহাসে দুটি নতুন অধ্যায়ের সুচিত করেন। প্রথমটি জাতির পিতার কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষন ও দ্বিতীয়টি হলো প্রধান মন্ত্রীর সততার জন্য বিশ্বদরবারে এক অকল্পনীয় বিশ্ব স্বীকৃতি। বেশ কয়েক জন বিশ্ব বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও গবেষকগণের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত পিপলস এ্যান্ড পলিটিক্স নামক গবেষনা সংস্থা সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ জেন্ডারসহ বিভিন্ন মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সুশাসন সহ বিভিন্ন নিয়ামক প্রশ্নে ভিত্তিতে বিশ্ব নেতৃত্বে সততার অবস্থান নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় স্থান অধিকারসহ মানবতার সেবায় বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি সরুপ “মাদার অব হিউমিনিটি” সম্মাননা পাওয়ায় বিশ্ববাসী তাকে অভিনন্দন জানায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার শপথ নেয়। ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা যেভাবে বাঙ্গালী জাতীকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে ছিলেন, তারই সুযোগ্য কন্যা দেশের সকলকে সঙ্গে নিয়ে ২০২১ সালে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত করার যে রূপকল্প প্রণয়নের। আজ বাংলাদেশ স্বল্পোন্ন দশে থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্দি, রপ্তারীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্পের উন্নয়ন, পদ্মা সেতু, যমুনা সেতুসহ বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ বাস্তবায়ন, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নানান কর্মকান্ডের কারেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব দরবারে মডেলে পরিণত হয়েছেন।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের উদ্দেশ্যে বিজয়ের মাসের এ আনন্দের শুভক্ষনে সকল অন্ধকার, সাম্প্রদায়িকতা, কুপমন্ডুকতা এবং অপশক্তিকে পরাভূত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে শেখ হাসিনা যে ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা বাংলার মানুষের হৃদয়ে চিরজাগরুক থাকবে, আর প্রশংসিত হবেন বিশ্ব ব্যাপী। বিশ্বের সমাজ চিন্তক এবং অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের এত দ্রুতগতিতে সামনে উঠে আসা এবং সামাজিক সূচক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারে চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি লাভ করায় বিস্মিত হয়েছেন। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। বাঙালি জাতি হিসাবে সকলের বিশ্বাস ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ দেশ হিসাবে গড়ে উঠবে। জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। গণতন্ত্রের মানস কন্যা ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, বাংলার দুঃখী মানুষের নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে যে কোন মূল্যে আমরা যোদ্ধাপরাধের কলঙ্কমুক্ত অসম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব। এ জন্য উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে আত্মনিয়োগ করব। বঙ্গবন্ধু জন্ম শতবার্ষিকীতে এটাই হউক আমাদের তথা সকল বাঙালির অঙ্গীকার।
সূত্র: মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট, বিভিন্ন পত্রিকা ও বাসস।
লেখক:
সম্পাদক- সমকালীন বাংলা